ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সর্বোৎকৃষ্ট বংশে সর্বোত্তম রাসূলের (সা.) আবির্ভাব

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৫ অক্টোবর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সর্বোৎকৃষ্ট বংশে সর্বোত্তম রাসূলের (সা.) আবির্ভাব

আমাদের প্রিয় নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিধন্য মাস চলমান। ক’দিন পরেই আসন্ন বারো রবিউল আউয়ালে দেশে দেশে পালিত হবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), সিরাতুন্নবী, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম প্রভৃতি নবী বন্দনা। আমরা বিভিন্নভাবে যত বেশি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলোচনায়, চিন্তা ও চেতনায় জারি রাখতে পারব তত বেশি আমাদের জীবন ও সমাজ সুন্দর হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোচনায় আমরা দেখি আল্লাহপাক তাঁকে চিরসুন্দর করে চিরশান্তির জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পরওয়ারদিগারের বিধান মান্য করা আমাদের জন্য ফরজ ও কল্যাণময়। সূরা আহযাবের ৫৭নং আয়াতে বলা হয়েছে : যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে পীড়া দেয় আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে তাদেরকে অপদস্থ করা হবে। যেমন অপদস্থ করা হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে। (মুজাদালাহ-৫)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বনবী এবং তাঁর আনুগত্য অপরিহার্য। এ বিষয়ে সূরা সাবার ২৮নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : আমি তো আপনাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। সূরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে বলা হয়েছে : আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর তাঁর রাসূলের এবং আনুগত্য কর তাদের যারা তোমাদের মধ্যে নির্দেশ দানের অধিকারী। তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ ঘটলে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট উপস্থাপিত কর। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (সূরা নিসা ৫৯)। সূরা হাশরের ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে : রাসূল (সা.) তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। তিরমিজি শরীফে এসেছে, ওয়াসিলা বিন আকসা থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : আল্লাহতায়ালা হযরত ইবরাহীম নবীর (আ.) সন্তানদের মধ্য হতে ইসমাঈলকে (আ.) শ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, আর হযরত ইসমাঈলের আওলাদ, ফরজন্দ থেকে কিনানা গোত্রকে মনোনীত করেছেন, বনী কিনানা হতে কুরাইশ বংশকে বেছে নিয়েছেন; (এভাবে) কুরাইশ থেকে বনী হাশিম গোষ্ঠীকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আর বনী হাশিম গোষ্ঠী থেকে আমাকে (নবী হিসেবে, আপন শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে) গ্রহণ করেছেন। হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ওহে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কতিপয় কুরাইশ বসে নিজেদের মাঝে বংশ গৌরব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিল। সেখানে আপনাকে এমন এক খেজুর গাছের সঙ্গে উপমা দিয়েছে যা কিনা জমিনের একটি উঁচু টিলায় অবস্থিত। তখন মহানবী (সা.) বললেন : আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিক‚ল সৃষ্টি করলেন আর আমাকে সবচেয়ে উত্তম দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি সমস্ত গোত্রকে উত্তমভাবে তৈরি করেছেন আর আমার আবির্ভাব সর্বোত্তম গোত্র হতে। অতঃপর উত্তম বানিয়েছেন সমুদয় ঘরগুলো, আর আমাকে সবচেয়ে উত্তম ঘরের (পরিবারের) অন্তর্গত করেছেন। সুতরাং আমি তাদের মাঝে উত্তম সকল পরিবারের দিক দিয়ে। সর্বশ্রেষ্ঠ হাফেজে হাদিস মহানবী (সা.) এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন : কতিপয় লোকজন একবার মহানবী (সা.) এর কাছে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কখন আপনার নবুওতের সূচনা হয়েছিল? জবাবে তিনি বললেন : যখন হযরত আদম (আ.) দেহ এবং রূহ এর মাঝামাঝিতে। অর্থাৎ যখন আদম (আ.) কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দেহ ও আত্মার সংযোজনে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেননি, তখনও আমি নবী ছিলাম। আমার সৃষ্টি এবং পদমর্যাদা সর্বাগ্রে প্রদান করা হয়। কিন্তু সমস্ত নবী-রাসূলগণের প্রেরণের পরে আখেরি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানসহকারে আমি দুুনিয়ায় আসি। সাহাবী আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘কিয়ামতের সময় যখন মানুষদের কবর থেকে উঠানো হবে তখন সবার আগে আমিই বের হব, আমিই হব (আল্লাহতায়ালার সঙ্গে) প্রথম সংলাপকারী যখন তারা (সবাই) আল্লাহর কাছে সমবেত হবে। তারা যখন নিরাশ হয়ে পড়বে আমি হবো তখন তাদের সুসংবাদদাতা এবং প্রশংসনীয় ঝাণ্ডখানা থাকবে আমার হাতে। আমি সকল আদম সন্তানের চেয়ে আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় ও প্রিয়তম হবো। আর এটি আমি কোন গর্ব করে বলছি না।’ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি: ‘(হে মুসলমানগণ!) যখন তোমরা কোন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান শুনতে পাও, তখন মুয়াজ্জিন যা উচ্চারণ করে তা তোমরাও বলে যাও। অতঃপর আমার ওপর দরূদ পাঠ কর। কেননা যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ এ জন্য তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন। তারপর আমার উদ্দেশে ‘ওয়াসিলা’ তালাশ কর (প্রার্থনা কর), নিঃসন্দেহে ‘ওয়াসিলা’ বেহেস্তের একটি বড় উত্তম স্থানের (মর্যাদার) নাম। এটি আল্লাহতায়ালার একজন মাত্র বান্দা ছাড়া আর কেউ পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে না। আমি প্রবল আশা রাখি যে, তা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনকারী ব্যক্তিটি হবো আমিই। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আমার জন্য এই ওয়াসিলা বা মাধ্যম প্রার্থনা করবে অর্থাৎ আজানের পর দোয়া/মুনাজাত করবে তার উদ্দেশ্যে পরকালে আমার সুপারিশ করা জরুরী হয়ে পড়বে।’- তিরমিজি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘নবীদের মধ্যে আমার উদাহরণ ঐ লোকের মতো, যে একটি ইটের দালান তৈরি করেছে আর তা খুব মজবুত, পূর্ণাঙ্গ এবং সুদৃশ্য বানিয়েছে। কিন্তু একটি মাত্র ইটের জায়গা সেখানে খালি রাখা হয়। ফলে লোকজন যখন প্রাসাদটি ঘুরেফিরে দেখছিল এবং আশ্চার্যান্বিত হচ্ছিল। তখন বলাবলি করছিল যে, যদি এই ইটটির স্থানও পুরো হয়ে যায় তাহলে কতই না উত্তম হতো। বস্তুত আমি নবী-রাসূলদের (আল্লাহ প্রদত্ত সিলসিলা ও প্রাসাদের মধ্যে) সেই ইটের মতো সর্বশেষ ও আখেরি সংযোজন।’ অন্যত্র তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন : আনা খাতামুন্নাবীঈন- আমি সবশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই...। আর একটি দীর্ঘ হাদিসে তিনি বলেছেন : আমিই সর্বপ্রথম বেহেস্তের দরজায় করাঘাত করব আর তা আমার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা খুলে দেবেন এবং তাতে প্রবেশ করাবেন। আর তখন আমার সঙ্গে থাকবে দরিদ্র মুমিনের দল, এ আমার কোন গর্ব নয়। এও আমি নিছক কোন গৌরব করে বলছি না যে, বস্তুত আমি পূর্বাপর সকলের চেয়ে সম্মানিত।’ - তিরমিজি। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘আমি কিয়ামতের দিন সমস্ত বনী আদমের দলপতি হব। কিয়ামতের দিন যাদের কবর ফেটে যাবে আমি তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হব। অর্থাৎ সর্বপ্রথম আমি কবর হতে উঠব এবং সর্বপ্রথম সুপারিশকারী হব। আর আমার সুপারিশই সর্বাগ্রে গ্রহণ করা হবে।’ - (মুসলিম)। হযরত রাসূলে কারীমের (সা.) ওপর দরূদ পাঠ করাও একটি ইবাদত। হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘যে ব্যক্তি একবার আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে আল্লাহপাক তার প্রতি দশটি রহমত নাজিল করেন এবং তার দশটি গুণাহ মাফ করেন; একই সঙ্গে তার দশটি মর্তবা বুলন্দ করেন।’ -(নাসায়ী)। তিনি আরও ইরশাদ করেছেন : ‘সে ব্যক্তি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হোক, যার সম্মুখে আমার আলোচনা করা হয় অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না।’- (তিরমিজি)। বুজুর্গ আলিমগণ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন যে, মহানবীর (সা.) পবিত্র নাম শোনার পর প্রথমবার দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। এরপর সে মজলিশে যতবার তাঁর মহান নাম শোনা যাবে ততবার দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×