ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বীমার উদ্যোগ শিক্ষার্থীবান্ধব

প্রকাশিত: ২১:১৭, ১৫ অক্টোবর ২০২১

বীমার উদ্যোগ শিক্ষার্থীবান্ধব

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো সকল শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্য ও জীবনবীমার আওতায় নিয়ে আসার সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতির অন্যতম উদাহরণ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা পুরো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অন্যতম উদাহরণ হিসেবে সুখ্যাত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নতুন দিগন্তের। বাংলাদেশের মানুষের সকল ঐতিহাসিক আন্দোলন ও বিজয়ের হৃৎপিণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ সঞ্চার করছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সময়োপযোগী উদ্যোগ, যার অন্যতম উদাহরণ সকল শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কিমিটির এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতন, দায়িত্ববোধসম্পন্ন ভাল গ্র্যাজুয়েট ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ন্যূনতম প্রিমিয়ামে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে সভাপতি করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক মাত্র ২৭০ টাকা প্রিমিয়াম প্রদান করে এখন থেকে শিক্ষার্থীরা তালিকাভুক্ত বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বীমা সুবিধাসহ- এরমধ্যে হাসপাতালে থাকাকালীন কেবিন/ওয়ার্ড ভাড়া, হাসপাতালসেবা, অস্ত্রোপচারজনিত ব্যয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল বাবদ দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা চিকিৎসা ব্যয় পাবে। এছাড়াও বহির্বিভাগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বার্ষিক ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে বহির্বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি বাবদ প্রতি ব্যবস্থাপত্রে সর্বোচ্চ পাঁচশত টাকা পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা খুবই অপরিহার্য। কারণ, পড়াশোনার পাশাপাশি সুচিকিৎসারও প্রয়োজন রয়েছে। স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা একাডেমিক সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাধারণত স্বাস্থ্য বীমা হলো এমন এক ধরনের বীমা, যা অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট চিকিৎসা ব্যয় বহন করে। এই খরচগুলো হাসপাতালে ভর্তির খরচ, ওষুধের খরচ বা ডাক্তারের পরামর্শ ফি সম্পর্কিত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা প্রদান করছে। বিশ্বের স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্ট শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নন-রেসিডেন্ট শিক্ষার্থীদেরকেও স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা প্রদান করে থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা অপ্রত্যাশিত চিকিৎসা ব্যয়ের আর্থিক বোঝা এড়াতে সাহায্য করবে এবং অবিলম্বে যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করবে। তাছাড়াও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত থাকলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের পরিবারের দুশ্চিন্তা অনেকাংশে লাঘব হবে এবং আর্থিকভাবেও তারা অনেকটা উপকৃত হতে পারবে। আরও বলা যায়, করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম যথাযথ সচল রাখার জন্যও সুচিকিৎসা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, যা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিশ্চিত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন মাইলফলকে পৌঁছবে বাংলাদেশ। তাতে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, যার আলোয় আলোকিত হবে পুরো বাংলাদেশ। গত এক দশকে শিক্ষার সর্বস্তরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন দেশকে বিশ্বের বুকে দিয়েছে পৃথক পরিচিতি, অর্থনীতির ভিত্তিকেও করেছে মজবুত ও টেকসই। গত কয়েক বছরে বদলে গেছে শিক্ষাক্ষেত্র, পাল্টে গেছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতি অত্যন্ত আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক, যা শিক্ষা বিস্তার ও তার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে শিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার বিবেচনায় নিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধি করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাস শুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরে পড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’-এর আলোকে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাণ-চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ এবং আগামী প্রজন্মকে দক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উদ্ভাসিত এবং আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সুযোগ ও সম্পদের প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরে সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে শিক্ষা খাতে। টাকার অঙ্কে যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫টি প্রকল্পের আওতায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে স্নাতক পর্যন্ত দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট (এসইএসপি) এবং মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন প্রকল্প (এসইএসডিপি) মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র-ছাত্রী, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের উপবৃত্তি (৪র্থ পর্ব) প্রকল্প এবং স্নাতক ও সমমানের উপবৃত্তি প্রকল্প চালু রয়েছে। সরকার এসব প্রকল্প থেকে ২০১৩ সালে ১ কোটি ২০ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার্থীসহ মোট প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থীকে ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। মাধ্যমিক থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত দেয়া এই বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে পেরেছে। এ বৃত্তির মধ্যে ৭৫ শতাংশই দেয়া হয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের। স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাস্ট ফান্ডে সরকার ১ হাজার কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করেছে। এই তহবিল থেকে এখন এক কোটি ২৮ লাখ শিক্ষার্থী বৃত্তি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য এ ফান্ড থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ ছাত্রীকে মোট ৭৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে কোন শিক্ষার্থী দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। এই তহবিল গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখতে এবং তাদের অভিভাবকদের বোঝা লাঘবে সহায়তা করছে। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও জীবন বীমার আওতায় নিয়ে আসার মহতী উদ্যোগ এতে যোগ করল নতুন মাত্রা, যা প্রকৃতই শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×