ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাদক নিয়ে পুলিশে গোপন অনুসন্ধান ॥ ৩ শতাধিক শনাক্ত চাকরিচ্যুত ৯০

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ১৪ অক্টোবর ২০২১

মাদক নিয়ে পুলিশে গোপন অনুসন্ধান ॥ ৩ শতাধিক শনাক্ত চাকরিচ্যুত ৯০

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আশঙ্কাজনক হারে মাদকাসক্ত সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। ফলে মাদক নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে গোপন অনুসন্ধান। ইতোমধ্যে তিনশ’ পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করে ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও শতাধিক সদস্য চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন। পুলিশ বিভাগকে মাদক সেবনে বিরত রাখার জন্য নিয়মিত রোলকলের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। চাকরি হারানোর আতঙ্কে দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণে অভ্যস্ত পুলিশ সদস্যরা গোপনে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াচ্ছেন। গত ৭ অক্টোবর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ডিএমপির প্রফেশনাল স্টান্ডার্ড এ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের উপপুলিশ কমিশনার মোছাঃ ফরিদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পুলিশের সব থানাসহ ৫৭ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত রোলকলের আওতায় আনা হচ্ছে। পাশাপাাশি সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান আরও কঠোর করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রথম পর্যায়ে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে উর্ধতন কর্মকর্তাদের আওতায় আনা হবে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কিছু সদস্য মাদক কারবারিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেকে মাদক সেবনও করছেন। এমনকি কেউ কেউ মাদক কারবার করছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে কয়েক পুলিশ সদস্যকে মাদক কারবার ও সেবনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে কঠোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি যেসব পুলিশ সদস্য মাদকাসক্ত বা মাদক কারবারে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে। নির্দেশনা পেয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। ডোপ টেস্টে যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশকে মাদকমুক্ত করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বিশেষ করে পুলিশের মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কোন পুলিশ সদস্যের মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সাসপেন্ড করে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হবে। কোন ধরনের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডোপ টেস্ট শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় ৩০ সদস্য শনাক্ত হওয়ার পর তদন্ত শেষে ১০ জনকে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও একাধিক সদস্য শনাক্ত হলে পুলিশের ভেতর এক ধরনের ডোপ টেস্ট আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই উদ্যোগকে বেশিরভাগ পুলিশের সদস্যই সাধুবাদ জানান। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে ডোপ টেস্টের আওতায় আনতে পারলে ভাল। পরে পুলিশের উদ্যোগটিকে আরও গতিশীল করতে পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপির পক্ষ থেকে আলাদা টিম গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পুলিশ সদস্যদের ওপর নজরদারি শুরু করেছে। কাউকে সন্দেহ মনে হলেই তাকে দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। পুলিশের ৫৭ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ঢাকায় কর্মরত পুলিশ বা সিভিল সদস্যদের মাদকদ্রব্য সেবন এবং শৃঙ্খলাজনিত কারণে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত ৯০ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে আপনার অধীনে কর্মরত সকল পুলিশ/সিভিল সদস্যকে মাদক সেবন থেকে বিরত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে রোলকলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে ওই চিঠি পাওয়ার পর প্রতিদিন ৩ দফায় (সকাল, দুপুর ও রাত) পুলিশ সদস্যদের মনিটরিং করা হচ্ছে। নিয়মিত রোলকল করা হচ্ছে। কোন সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। সে সদস্য নির্দিষ্ট কারণ দেখাতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এ্যালকোহল এনালাইজার দিয়েও টেস্ট করানো হচ্ছে। সেখানে পজিটিভ পাওয়া গেলে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে। সেখানেও পজিটিভ আসলে সাসপেন্ড করে বিভাগীয় মামলা দায়েরের পর চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়। এরপর কমিশনার চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেন। এখানে কারও বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের কোন সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি থানা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সে হিসেবে মাদকাসাক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এ্যাকশনে নামছে মনিটরিং টিম। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে ডোপ টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করে চাকরিবিধি মেনে বাহিনী থেকে বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে পুলিশের সকল ইউনিটে ও সকল রেঞ্জে ডোপ টেস্ট ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ডোপ টেস্ট আতঙ্ক। মাদকের সঙ্গে জড়িত যে ৯০ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই এসআই, সার্জেন্ট, এএসআই, নায়েক ও কনস্টেবল। তবে কনস্টেবলের সংখ্যা বেশি। সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে এর সংখ্যা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে নাম প্রকাশ করারও পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের।
×