ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাজির পট যেমন হতো তেমনি হতো দুর্গা বা লক্ষ্মীপট

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৪ অক্টোবর ২০২১

গাজির পট যেমন হতো তেমনি হতো দুর্গা বা লক্ষ্মীপট

মোরসালিন মিজান ॥ হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি/তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা...। পটের গল্পে ঢোকার মুহূর্তে, হ্যাঁ, কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে গেল। তবে পটচিত্রের কথা এখন আর কারও তেমন মনে থাকে না। কত কিছু যে আঁকতেন পটুয়ারা! বিশেষ করে ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন ছবি এঁকে সে ছবির কাহিনীও বর্ণনা করতেন তারা। বিখ্যাত গাজীর পটের কথা অজানা নয় কারও। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে গাজীর পট ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপট লক্ষ্মীপট বা মহাভারত রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রের ছবি সামনে রেখে পূজা করতেন। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে বলি, পটচিত্র মানে, পটে আঁকা চিত্র। পট শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশী রং দিয়ে বিশেষ এ ছবি আঁকা হয়। বাংলায় সাধারণত দু-ধরনের পট প্রচলিত রয়েছে। একটি চৌকাপট। অন্যটি বহুপট বা দীর্ঘপট নামে পরিচিত। যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না, তখন এ পটচিত্র প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত চর্চাটি বিশেষ জোরালো হয় বলে জানা যায়। যারা পট আঁকেন তারা পটুয়া নামে পরিচিত। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশাণুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করতেন। চিত্র দেখিয়ে গানও করতেন তারা। বিষয় বেঁধে পট ছয় ছয় রকমের। এই যেমন, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, পরিবেশগত ও বিষয় নিরপেক্ষ পট। তবে চর্চার শুরুটা ধর্মীয় পট দিয়েই হয়েছিল। ধর্মীয় বিশ্বাসকে মজবুত করে এমন গল্প পৌরাণিক কল্প-কাহিনী পটচিত্রে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হতো। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল গাজীর পট। গাজীর পটে গাজীকালু চম্পাবতীর কাহিনী, গাজী পীরের বীরত্বগাথা অলৌকিক শক্তি ইত্যাদির চিত্ররূপ উপস্থাপন করা হতো। সেইসঙ্গে গানে গানে বর্ণনা করা হতো কাহিনী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল রামকাহিনী কৃষ্ণকাহিনী। মহাভারত ও রামায়ণের আলোচিত চরিত্রগুলো উজ্জ্বল রঙে আঁকা হতো। একইভাবে আঁকা হতো দুর্গাপট ও লক্ষ্মীপট। মাটির প্রতিমা গড়ে পূজা করার সাধ্য যাদের ছিল না তারা পটের আশ্রয়ে দেব দেবীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। রঙিন দুর্গোৎসব সম্ভব না হলেও শতভাগ ভক্তি নিয়েই পূজা হতো দুর্গাপটের। একইভাবে আঁকা ছবি সামনে রেখে দেবী লক্ষ্মীর অর্চনা করা হতো। তবে বর্তমানে প্রাচীন এই লোক শিল্পের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন পটুয়া সীমাবদ্ধতার মধ্যেই চর্চাটি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদেরই একজন মুন্সীগঞ্জের পটুয়া শম্ভু আচার্য। বিখ্যাত শিল্পী একসময় তার পটে মহাভারত ও রামায়ণের চরিত্র এঁকেছেন। তার সাম্প্রতিক কালের পটচিত্রেও রামায়ণের কাহিনী লক্ষ্য করা যায়। একটি পটের কেন্দ্রে তিনি এঁকেছেন রাবণ বধের মুহূর্তটি। এর চারপাশে আলাদা আলাদা ফ্রেমে আরও বেশ কিছু ছবি। খ-চিত্রে সমস্ত ঘটনাবলি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার শিল্পিত প্রয়াস। অপর পটচিত্রে মহাভারতের উপাখ্যান। এখানে কুরুক্ষেত্রের অর্জুনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। পঞ্চপা-বের অন্যতম অর্জুন তার রথে চড়ে ছুটে চলেছেন। সঙ্গী হয়েছেন কৃষ্ণ। শম্ভুর পটের মূল রংটি লাল। এর পর চোখে পড়ে সবুজ আর নীল রঙের ব্যবহার। প্রাকৃতিক রং আর ফর্মের ভিন্নতার কারণে ছবি দুটি আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে। কথা প্রসঙ্গে পটুয়া বলছিলেন, একসময় রামায়ণপট মহাভারতপট খুব জনপ্রিয় ছিল। দুর্গা পূজার সময় রামায়ণগান করা হত। ম-পের মঞ্চের দৃশ্যমান কোন স্থানে পট ঝুলিয়ে রেখে রামায়ণ গান গাওয়া হতো। এ পট দেখিয়ে বর্ণনা করা হতো রাবণ বধের কাহিনী। শম্ভু জানান, পটে আঁকা দেব দেবীদের মধ্যে থাকতেন মনসাও। প্রধানত বাংলা অঞ্চল এবং উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তার পূজা প্রচলিত আছে। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তার পূজা করা হতো। দেবী মনসার পট দেখিয়ে বেহুলা লক্ষিন্দরের সেই চিরচেনা কাহিনী বর্ণনা করতেন পটুয়ারা। পটে প্রচুর পরিমাণে আঁকা হতো শীতলা দেবীর ছবি। কারণও আছে। একসময় মহামারী থেকে বাঁচার স্বীকৃত কোন পথ জানা ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের। রোগ ব্যাধির কাছে সবাই ছিল অসহায়। সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তা কাছে প্রার্থনা করতেন তারা। একই প্রার্থনা হতো পটের ভাষায়। পটুয়ারা বিশেষ করে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতেন বলে জানান শম্ভু আচার্য। তিনি বলেন, বসন্ত দেখা দিলে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে একটি বাক্সের ওপর বসিয়ে সে বাক্স গলায় ঝুলানো হতো। পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেবীর পট দেখানো হতো। এভাবে চলত চাল ইত্যাদি সংগ্রহ। পরে ছবির সামনে পূজার আয়োজন করে রোগমুক্তির প্রার্থনা করা হতো বলে জানান তিনি। তবে বর্তমানে এসবের বেশিরভাগই স্মৃতি। দুঃখ করে শম্ভু আচার্য বলেন, আমরা আমাদের অতীত ভুলে যাচ্ছি। পটচিত্রের প্রাচীন ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তপ্রায়। আমরা কিছু মানুষ কাজ করছি। এর পর কী হবে জানি না। দেশের আরেক বিখ্যাত এবং প্রবীণ পটুয়া নিখিল চন্দ্র। আঁকার পাশাপাশি পটচিত্র অঙ্কন শেখান তিনি। ঢাকার বাইরে থাকলেও এখানে এসে বিভিন্ন কর্মশালা পরিচালনা করেন। এর বাইরে সারা বছরই কম বেশি পট আঁকেন। সমকালীন নানা বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষেও পটচিত্র এঁকেছেন শিল্পী। তার পটে দুর্গা-দেবীসহ অন্যান্য দেব-দেবীর ছবি। ম-পে যেসব দেব-দেবীর পূজা হয় তাদের প্রায় সকলকে পটের ফর্মে তুলে ধরেছেন শিল্পী। পটচিত্রে মাটির তৈরি প্রতিমার ফর্ম। প্রাকৃতিক রং। উজ্জ্বল হলুদ বা লাল রঙে যেন উৎসবের আনন্দটাকে ধরার চেষ্টা। তবে শিল্পীর মনে আনন্দ নেই। শম্ভু আচার্যের মতোই হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, লোক শিল্পের অত্যন্ত প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পটচিত্র। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনের এই যুগে আরও অনেক কিছুর মতো এটিও প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। পটুয়া তৈরি হচ্ছে না। পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ঐতিহ্যের প্রতি টান কমেছে। তিনি জানান, এখন ঠিক পূজার উদ্দেশ্যে নয়, শিল্পকর্ম হিসেবেই দুর্গাপট আঁকেন তিনি। রাজধানীকেন্দ্রিক শৌখিন শিল্পপ্রেমীরা এর কিছু কদরও করে থাকেন। কিন্তু এতে হবে না। চর্চাটি বাঁচিয়ে রাখতে হলে, বাঁচিয়ে রাখা তো নয়, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র ও সরকারকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্র বা সরকার কি তা মনে করছে?
×