ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুদি দোকানির বিস্ময়কর উত্থান, রাতারাতি কোটিপতি

প্রকাশিত: ২৩:১১, ১৪ অক্টোবর ২০২১

মুদি দোকানির বিস্ময়কর উত্থান, রাতারাতি কোটিপতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছিলেন মুদি দোকানদার। সবাই তাকে গ্রামের একজন দোকানি হিসেবেই জানতেন। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি হয়ে গেলেন কোটিপতি। সাইফুল নামের যুুবক বিস্ময়কর উত্থান দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। কানাঘুষা চলতে থাকে। সে খবর পৌছে যায় র‌্যাবের কাছেও। তখনই সব রহস্য উন্মোচন হয়ে যায়। র‌্যাব এমনই এক মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ফেলে। সিন্ডিকেটের অন্যতম সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুলের (৩৮) বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কামন্দী গ্রামে। এইচএসসি পাস টুটুল ছিলেন মুদি দোকানদার। ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিনি। এক পর্যায়ে অধিক অর্থ আয়ের লোভে জড়িয়ে পড়েন মানবপাচার চক্রে। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতেন টুটুল। পরে নিজেই খোলেন তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠান। তবে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার ও শিক্ষিত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাচার করেন তিনি। হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। টুটুলের এ প্রতারণার কাজে অন্যতম সহযোগী মোঃ তৈয়ব আলী (৪৫)। চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। এর আড়ালে টুটুলের মানবপাচার চক্রের সহায়তায় অসংখ্য মানুষকে বিদেশে প্রেরণ এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এভাবে মুদি দোকানদার থেকে তিন ওভারসিজ মালিক বনে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ ৮ জনকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব-৪। গ্রেফতার হওয়া বাকিরা হলেন, গোপালগঞ্জের শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), মেহেরপুরের মোঃ মারুফ হাসান (৩৭), জাহাঙ্গীর আলম (৩৮) ও লাল্টু ইসলাম (২৮), শরীয়তপুরের আলামিন হোসাইন (৩০), কুষ্টিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন (৫৪)। বুধবার কাওরানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক এসব তথ্য জানান। এ সময় তিনি জানান, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবকের মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব-৪ ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড্ডা থানার লিংক রোডে অবস্থিত টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে দুই নারীসহ চার ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ১০টি পাসপোর্ট, ৭টি ফাইল, ৪টি সিল, ১৭টি মোবাইল, ৫টি রেজিস্টার, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ২টি কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট ও নগদ ১০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। এ সময় মানবপাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএসসি পাস টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার ছিলেন। মাঝে-মধ্যে ঢাকায় আসতেন। লোভে পড়ে মানবপাচারকারী চক্রে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন। পরে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় খুলে বসেন টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামে তিন এজেন্সি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত অনেক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আবু তৈয়ব টুটুলের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী। পড়ালেখা না জানা তৈয়ব চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দিতেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। টুটুলের প্ররোচনায় চক্রে জড়িয়ে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে মানবপাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। অনেককে দিয়েছেন চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্রও। র‌্যাবের মতে, মানবপাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিক্যাল সম্পন্ন করাসহ অন্য কাজে সহায়তা করে আসছিলেন। প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা টার্গেট সংগ্রহে দেশের বেকার ও অসচ্ছল তরুণ-তরুণীদের সৌদি আরব, জর্দান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেয়ার নামে প্রলুব্ধ করত। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় হোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাত। মোজাম্মেল হক বলেন, টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়িতে কাজের নামে পাঠানোর ভুয়া মানিরিসিট প্রদান করে। এ বাবদ মাথাপিছু ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিত তারা। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারী চক্রের কজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতেন চক্রের সদস্যরা। চক্রের কয়েকশ’ সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতেন। এতে ভিকটিমদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকত না। পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গেও সখ্য ছিল চক্রের সদস্যদের। কথিত মেডিক্যাল টেস্ট শেষে নারী ভিকটিমদের বাসাবাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্দান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত তারা। ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারত না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরত নিতে যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো। এ সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেফতার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র প্রদান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করেন তিনি। বিষয়টি এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তৈয়ব। তাদের বৈধতা না থাকার পরও কীভাবে মানবপাচার করছিল টুটুল-তৈয়ব চক্র এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিন ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র‌্যাবে যোগাযোগ করেছেন। প্রতারিত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হয়রানির অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করেছেন। বৈধ কোন জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানবপাচার করতে না পারে সে জন্যই র‌্যাবের এই অভিযান। এ ধরনের আরও বেশ কজন মানবপাচারকারীর তথ্য রয়েছে র‌্যাবের হাতে। তাদের ওপর নজরদারি চলছে।
×