ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছলচাতুরীতে টোপ ॥ ই-কমার্সের পথে এফ-কমার্স

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৪ অক্টোবর ২০২১

ছলচাতুরীতে টোপ ॥ ই-কমার্সের পথে এফ-কমার্স

রহিম শেখ ॥ করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশে ই-কমার্সের যেমন জোয়ার আসে তেমিন উত্থান ঘটে এফ-কমার্সেরও। সম্প্রতি ইভ্যালিসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা পাচার ও স্থানান্তর করার অভিযোগ উঠেছে। ই-কমার্সের মতো এফ-কমার্সেও বাড়ছে প্রতারণা ও অর্থ লোপাটের মতো ঘটনা। ফেসবুকে অন্তত ১০ লাখ ছোটবড় উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা পেজ খুলে ইলেকট্রনিক পণ্য, গেজেটস, ফ্যাশনসামগ্রী, কসমেটিকসসহ নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেসবুকে কেনাকাটা নিয়ে অভিযোগ দিলেও গুরুত্ব দেয় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারকরা থাকছেন নজরদারি ও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব মতে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১০ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ। আর এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আছেন। সর্বশেষ আগস্ট মাসের হিসাবে দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার, যার ৪০ ভাগ নারী। বিপুলসংখ্যক এই ব্যবহারকারীর কাছে পণ্য বিক্রির সহজ মাধ্যম ফেসবুক। তবে এক্ষেত্রে বেড়েছে প্রতারকের আনাগোনা। তারা নানা কৌশলে ক্রেতা ঠকাচ্ছেন। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব এবং ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান সূত্র বলছে, ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তার সংখ্যা ১০ লাখের কম নয়। ই-কমার্স ভিত্তিক কুরিয়ার সেবা ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী বিপ্লব ঘোষ রাহুল বলেন, তারা গড়ে দিনে প্রায় ২৫ হাজার অর্ডার ডেলিভারি দেন, যার অধিকাংশই ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তাদের অর্ডার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্সের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারির কারণে ডেলিভারি কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুককেন্দ্রিক ব্যবসায় নানা ধরনের প্রতারণা হচ্ছে। এর মধ্যে এক ধরনের প্রতারক যাদের কোন পণ্যই নেই কিংবা ব্যবসা নেই: ভুয়া পেজ খুলে অন্য কোন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পণ্যের ছবি আপলোড করে ক্রেতা আকৃষ্ট করছেন। তারা ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার নিয়ে অর্থ হাতিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। পেজ ডিজএ্যাবল করে দিচ্ছেন। ক্রেতারা ওই পেজ কিংবা তাদের ফোন নম্বরে খুঁজে না পেয়ে বুঝতে পারছেন প্রতারিত হয়েছেন। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান ফেসবুকের একটি পেজে ছবি দেখে ২ হাজার ৫০০ টাকার একটি ড্রেস অর্ডার করেন। মেসেঞ্জারে জানানো হয়, ডেলিভারির আগে টাকা পরিশোধ করতে হবে। তিনি ফেসবুক পেজে দেয়া মোবাইল নম্বরে বিকাশ করে দেন। কিন্তু ডেলিভারির পর দেখা যায়, ছবি দেখিয়ে তিনি যে ড্রেস অর্ডার করেছেন, সেটা তাকে দেয়া হয়নি। এমনকি তিনি যে ড্রেসটি পেয়েছেন, সেটা নিম্নমানের। মেসেঞ্জারে বিষয়টি জানানো হলে সরবরাহকারী বলেন, যেটা অর্ডার করা হয়েছে সেটাই তারা পাঠিয়েছেন। ফেসবুকের একটি পেজে মেয়েদের টপস, প্লাজো, নাইটিসহ বিভিন্ন পণ্য দেখে পছন্দ করেন রায়হানা শামস। মেসেঞ্জারে পছন্দের পণ্যের ছবি দেখিয়ে অর্ডার দিলে পাওয়া যাবে কিনা জানতে চান। উত্তরে জানানো হয়, ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে। পছন্দের পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা দিলেই হবে। কিন্তু অর্ডার করার সময় কিছু টাকা দিতে হবে। একটি বিকাশ নম্বরও দেন তারা। রায়হানা মেয়েদের দুটি টপস ও দুটি প্লাজো অর্ডার দেন। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা বিকাশ করেন তিনি। কিন্তু প্রায় দুই মাস পার হলেও এখনও অর্ডার করা পণ্য পাওয়া যায়নি। কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে ২/৩ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেয়া হবে বলে একাধিকবার আশ্বস্ত করা হলেও কাক্সিক্ষত পণ্য বা টাকা কোনটাই পাওয়া যায়নি। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ফেসবুকভিত্তিক কেনাকাটায় প্রতারণার ঘটনা নিয়ে আমাদের কাছে প্রচুর অভিযোগ আসছে। অনেক উদ্যোক্তার তো কোন ট্রেড লাইসেন্স নেই, ডকুমেন্ট নেই। ফলে তারা প্রতারণা করলে ধরা কঠিন। এজন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের এনআইডির মতো ডকুমেন্ট নিয়ে যেন তাদের ব্যবসায়ের অনুমতিপত্র দেয়া হয়। এতে যেমন এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে, তেমনি প্রয়োজনে সহযোগিতাও করা সম্ভব হবে। অনলাইন ব্যবসায় ঠকলেই প্রতিকারের একমাত্র জায়গা এখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সকাল থেকে সন্ধ্যা- বলা যায় সারাদিনই এই ব্যবসা নিয়ে জমা পড়ছে অভিযোগ। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পণ্য না পাওয়ার কারণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে ৪ হাজার ৯৮২টি। ফেসবুক পেজে পণ্য দেয়ার কথা বলে আর দেয়া হয়নি, অথবা পেজে যে পণ্যের ছবি দেয়া হয়, সেই পণ্য না পাওয়ায় অভিযোগ করা হয়। এ পর্যন্ত ৪ হাজার ২৮৮টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে অনেক অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ পেজে পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর ঠিকানা এবং ফোন নম্বরের অনুপস্থিতি। ফলে ভোক্তা প্রতারিত হলেও পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকারের এই সংস্থা। জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা জানান, পণ্য বিক্রি এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনও দুর্বলতা আছে। ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স কর্মকা-ে ঠকছেন ক্রেতা। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা পেজগুলোতে উৎপাদনকারীর নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেয়া থাকে না। ফলে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না।
×