ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

নিরাময় অযোগ্য রোগীর জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার

প্রকাশিত: ২১:০০, ১৪ অক্টোবর ২০২১

নিরাময় অযোগ্য রোগীর জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার

জন্মের পর মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে অবধারিত মৃত্যু। তবুও সবার প্রত্যাশা থাকে মৃত্যু যেন বেদনাহীন, যন্ত্রণাহীন, মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদ হয়। অনেক সময় সেটা হয়ে ওঠে না। নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিরাময় অযোগ্য জীবন সীমিত হয়ে আসা রোগীদের সর্বাত্মক পরিচর্যা প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছে এক বিশেষ ব্যবস্থা। যার নাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমনমূলক সেবা হলো সর্বাত্মক ও বহুমুখী নিয়মানুবর্তিতামূলক চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে গুরুতর অসুস্থ মানুষের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যান্সার, ফুসফুস ও কিডনি বৈকল্য, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা, যকৃতের রোগ বা অন্য কোন দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য প্রশমন সেবার প্রয়োজন হয়। প্রশমনমূলক সেবা হচ্ছে নিরাময় অযোগ্য রোগীদের সবচেয়ে বড় ওষুধ। এই সেবায় রোগীদের অসহ্য যন্ত্রণার অনেকাংশে প্রশমিত হয়। নিরাময় অযোগ্য রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- প্রচ- মাথাব্যথা বা অসহ্য যন্ত্রণা। চিকিৎসার পাশাপাশি এই সেবার মূল উদ্দেশ্য জীবনের মান বাড়ানো। আমাদের দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার শব্দটি এখনও অপরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ছাড়া অনেকেই এই শব্দটির সঙ্গে অপরিচিত। প্যালিয়েটিভ চিকিৎসার মুল বিষয় হলো ব্যথা নিরাময় করা। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু রয়েছে। যেমন-শ্বাসকষ্ট, খেতে না পারা এবং মানসিক সমস্যা। একজন মানুষের শেষ সময়ে এটা খুবই প্রয়োজন। এর পরও যদি রোগী মারা যায়, সেই পরিবারের জন্য যে সাপোর্ট সেটাও কিন্তু প্যালেয়েটিভ কেয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার শুরু হয ২০০৬ সালে। বাচ্চাদের প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিয়ে শুরু হয়। এরপর বড় আকারে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ কেয়ার। এর পর থেকে সবাই এই সম্পর্কে ধারণা নিতে শুরু করে। শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, হোমকেয়ার ও কমিউনিটি ভিত্তিক তিন ধরণের প্যালিয়েটিভ সেবা দিয়ে আসছে। ২০০৮ সাল থেকে হোম বেইসড প্যালিয়েটিভ সেবা প্রদান করা হয়। প্যালিয়েটিভ কেয়ার দল চিকিৎসা ও নার্সদের সহায়তায় বিএসএমএমইউ’র ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নিরাময় অযোগ্য রোগীদের বাড়িতে গিয়ে হোম বেইসড প্যালিয়েটিভ সেবা প্রদান করে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের এক গবেষণা দেখা গেছে, নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা কম এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকাদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি রোগীই ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মাঝে বেশির ভাগ রোগীরই প্রধান লক্ষণ ছিল ব্যথা। জীবন সীমিত ও নিরাময় অযোগ্য রোগী এবং তার পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক সেবা প্রদানের একটি সার্বিক প্রচেষ্টা প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ নিরাময় অযোগ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। গবেষণায় জানানো হয়, প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা বা হাসপাতাল দ্বারা রেফার হয়ে হোম কেয়ারের জন্য এসেছেন। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই লিম্ফিডিমা কেয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও এই রোগীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা ও দুশ্চিন্তার লক্ষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশ রোগী মনোসামাজিক ও আধ্যত্মিক সেবা পেয়েছেন। গবেষণা ফলাফলে আরও বলা হয় রোগীদের অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৫০-৮০ বছরের মধ্যে ছিল। ৮৭ শতাংশ রোগী মহিলা। ৮৩ শতাংশ রোগী বিবাহিত। ৬৬ শতাংশ রোগী গৃহিণী/গৃহকর্তা। ৫২ শতাংশ রোগীদের জন্য চিকিৎসার খরচ নিজের এবং বন্ধুদের ও পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে অর্থায়ন করা হয়। যে কারও পরিবারে কোন সদস্যেরও সেবা যে কোন সময়ে প্রয়োজন হতে পারে। দেশের সরকার স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট উন্নয়ন অর্জন করেছে। যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে। তথাপি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মতো স্বল্প ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা সর্বস্তরে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যা করা খুবই জরুরী। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×