ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পলাশী থেকে দুর্গাপূজা

প্রকাশিত: ২১:০৮, ১৩ অক্টোবর ২০২১

পলাশী থেকে দুর্গাপূজা

বৈদিক এবং আদিবাসী দেবদেবীদের মধ্যে ‘মা’ ধারণার পূজা ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু যেভাবে এখন, যে আচারে-আয়োজনে দুর্গাপূজা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত হিন্দুদের মূর্তিপূজায় দুর্গাকে এই রূপে পূজা করার উল্লেখ তেমন নেই। দুর্গাকে এমন ঘরের মেয়ে করে পূজা করার উল্লেখ আমরা পাই সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে। এসবের মধ্যে আবার অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে রয়েছে পলাশীর যুদ্ধ। বিশ্বাসঘাতকতার ঐতিহাসিক উদাহরণ বা বাংলায় ইংরেজ শাসনের ইতিহাসের সূত্রপাত হিসেবেই শুধু নয়, বাংলায় দুর্গাপূজার শুরু এবং বিস্তারের নেপথ্যেও পলাশীর যুদ্ধের ভূমিকা রয়েছে অনেকটাই। মুঘলদের থেকে পৃথক হয়ে নবাবরা বাংলা শাসন করার সময় থেকেই এই অঞ্চলে হিন্দু জমিদারদের উদ্ভব হয়। আস্তে আস্তে জমিদাররা নিজেদেরই ক্ষমতাবলে হয়ে ওঠেন প্রাদেশিক রাজা। নামে যখন রাজা তখন প্রজাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাও রাজার অধিকারেই পড়ে। বলাবাহুল্য, এই প্রাদেশিক রাজারা নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করলেও আসলে কিন্তু নবাবদের হাতেই ছিল ক্ষমতার মূল রাশ। এই গোটা ছবিটা পালটে যায় ১৭৫৭’র পর থেকে। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাবদের হার শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক জীবনযাপনেও অদ্ভুত বদল আনে। যুদ্ধের পরপরই প্রাদেশিক রাজাদের এক ছদ্ম ক্ষমতায়ন ঘটে। এতদিন প্রজাদের শাসন করলেও আসল ক্ষমতা ছিল বকলমে নবাবদের হাতেই। প্রাদেশিক রাজাও জানতেন জমিদারের ভূমিকায় আসলে এ কেবলই রাজা রাজা খেলা। ইংরেজদের জয় এবং রাজ্য শাসনের মূল জায়গায় তাদের প্রবেশ জমিদারদের মনে দীর্ঘদিনের লালিত অভীপ্সায় নতুন করে নাড়া দেয়। প্রজাদের খানিক নিজের বশে রাখা এবং মালিক ইংরেজদের তোষামোদে রাখতে দুর্গাপূজাকে সামনে নিয়ে আসেন জমিদাররা। প্রায় সমস্ত জমিদার বাড়িতেই ঘটা করে দুর্গাপূজার আয়োজন হতে থাকে। বেশ কয়েকদিন ধরেই জমিদার বাড়িতে চলত জাঁকজমকের পূজা, খাওয়া-দাওয়া এবং যাত্রাপালা অনুষ্ঠান। পূজাকে উপলক্ষ করে জমিদারিত্বের মেয়াদ বাড়ানো এবং সুনজরে থেকে শাসকের অধীনে ছোট শাসক হয়ে ওঠাই ছিল প্রাদেশিক রাজাদের পাখির চোখ। জানা যায়, পলাশীর যুদ্ধে নবাবদের হারানোর পরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে চেয়েছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। কিন্তু কলকাতা শহরের একমাত্র চার্চটি নবাবরা ধ্বংস করে ফেলায় সেই পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ক্লাইভের ব্যক্তিগত সচিব নবকৃষ্ণ দেব তার বাড়িতে দুর্গাপূজায় ক্লাইভকে আমন্ত্রণ জানান। ধুমধাম করে পূজা হয় কলকাতার শোভাবাজারে নবকৃষ্ণের বাড়িতে। যদিও মনে করা হয়, ক্লাইভ এবং দুর্গাপূজার এই গল্পটি নবকৃষ্ণ নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিলেন। তবু পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজাকে ‘কোম্পানির পূজা’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়ে আবার চরিত্র পালটায় দুর্গাপূজা। বিশেষ করে বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর এই সময়ে নারীর খোলস বদলে দুর্গাকে যেন দেশমাতার ভূমিকাতেই বেশি করে ভাবতে চান বিপ্লবীরা। অবশ্য শুধু দেশমাতা বললে ভুল হবে। ইংরেজদের শাসন থেকে দেশকে বাঁচাতে একদিকে দেবী দুর্গাই হয়ে ওঠেন শক্তির প্রতীক। অন্যদিকে দুর্গাই হয়ে ওঠে দেশ। দেশ মানে মাতৃভূমি। মায়ের ভূমিকে রক্ষাই যেন হয় বিপ্লবীদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান এবং লক্ষ্য। ইতিহাসবিদদের মতে, দুর্গার এই চরিত্র বদলের পেছনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’র (১৮৮২ সালে লেখা) ভূমিকা অসামান্য। সন্ন্যাসী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে সেই দুর্গাকে বা বলা ভাল শক্তির বিভিন্ন মৃন্ময়ী রূপকে আন্দোলনকারীরা কীভাবে দেশের সঙ্গে দেখা একই স্থানে রাখছেন, তা একেবারেই স্পষ্ট। উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দে মাতরম’ গান বিপ্লবীদের লড়াইয়ের অন্যতম মন্ত্র। বাঙালী চালিত প্রেসগুলোতে দুর্গা প্রতিমার ছবির ওপর বহু দেশাত্মবোধক গান ছাপা হয়। সেই সময়েই লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে বিভিন্ন পত্রিকায় পূজাবিষয়ক লেখাতেও দুর্গার এই দেশমাতায় বিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইংরেজদের শাসনে তার সন্তানদের দুর্বিষহ সময় যাপন, খরা, বন্যা এবং দুর্গতি থেকে মুক্তির জন্য দুর্গতিনাশিনী হিসেবে দুর্গার উল্লেখ রয়েছে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত পত্রিকা ব্যাঙ্গলিতেও। ১৯০৫সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই সম্ভবত দুর্গাপূজায় গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে। স্বদেশী আন্দোলনের ব্যাপ্তি বাড়াতে এই উৎসবই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। প্রায় প্রতিটা পূজার বিজ্ঞাপনেই নজরে আসে ‘নাথিং বিদেশী, এভরিথিং স্বদেশী’ জাতীয় পাঞ্চলাইন। সকলের জন্য এবং সকলকে নিয়ে সর্বজনীন দুর্গাপূজার ধারণাটিও শুরু হয় এই সময় থেকেই।১৯২৫-এর সেপ্টেম্বর মাস। জেলে বসেই বন্ধুকে চিঠি লেখেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। জানান, জেলের মধ্যে থেকেও পূজার আয়োজনের অনুমতি মিলেছে। সেই সময়ে পূজাকে কেন্দ্র করে লাঠিখেলার মতো প্রদর্শনী চালু হয়; যা আদতে বিপ্লবীদের অনুশীলনেরই অঙ্গ ছিল। সেই প্রথা মেনে আজও বাগবাজারে অষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী পালন হয়। স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পূজায় প্রতিমাকে তখন খাদি বস্ত্র পরানো হতো। পুতুল ও অন্যান্য খেলার প্রদর্শনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ও তুলে ধরা হতো। তোষামোদের আয়োজন থেকে বিপ্লবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তির পন্থা হিসেবে দুর্গাপূজায় বিবর্তনের আঁচড়গুলো নিঃসন্দেহে স্পষ্ট। শাসকের মুখের ওপর কখনও সুপারইম্পোজ হতে থাকে ব্রিটিশ গবর্নর জেনারেলের আদল, কখনওবা বর্তমান রাজনৈতিক দলের ঝা-ার রং। গল্প আসলে একই। বহুকালের শিকড়ওয়ালা একটা উৎসব, পোশাক বদলে বদলে হয়ে উঠছে কার্নিভ্যাল। একটা সাধারণ উদ্দেশ্যে বিপ্লবের সঙ্গে মানুষের অন্তর্ভুক্তির তাগিদ এখন আর দুর্গাপূজার নেপথ্য নয়, বরং পূজা নিজেই এখন বহু শিল্প এবং শিল্পীর বেঁচে থাকার নেপথ্যের গল্প। লেখক : আবৃত্তিশিল্পী ও ব্যাংকার সংগঠক
×