ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টরোন্টোর চিঠি ॥ এখানে ঘড়ি ধরে ঋতু বদলায়

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৩ অক্টোবর ২০২১

টরোন্টোর চিঠি ॥ এখানে ঘড়ি ধরে ঋতু বদলায়

ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার সময় বোধহয় হয়ে এলো পৃথিবীর এ গোলার্ধে। ‘সামার’ যে কেবল একটি ইংরেজী শব্দ নয়, এ শব্দের মাঝে যে লুকিয়ে থাকতে পারে বহু মানুষের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, সেটি প্রথমবার টের পেয়েছিলাম বেশ ক’বছর আগে। প্রথমবারের মতো কানাডায় আসার পরে। এখানকার মানুষরা যে ওই সামারের চার মাসের অপেক্ষায় থাকে সারাবছর। গ্রীষ্মের উষ্ণ হাওয়া, রৌদ্রোজ্জ্বল সারাবেলা মৌতাতে মাতায় তাদের। সে গল্প না লিখলেও ভেসে বেড়ায় টরন্টোর অলিতে-গলিতে। তারপর একদিন, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে টরন্টোর বুকে। এ যেন প্রকৃতির বেখেয়ালি আবেগ, তবুও একেবারে ঘড়ি ধরে সময়কে খোলনলচে পাল্টে দেয়া! আপনি প্রকৃতিতে বিশ্বাসী কিংবা ধর্মে। মানুষে কিংবা সঙ্গীতে আপনার জীবনযাপন। ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা আপনি অবলোকন করবেন এই অদ্ভুত ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তটি। এখানে ঘড়ি ধরে ঋতু পাল্টায়। বেশ কদিন হলো ‘ফল’ এসেছে। আমার কাছে এ যেন প্রিয় বাংলার শরতকাল। গ্রীষ্মের শেষেও আছে নানা আয়োজন। শরতকাল হচ্ছে কানাডিয়ানদের জন্য গ্রীষ্ম আর শীতের মাঝের মেলবন্ধন। প্রচুর তুষারপাতের কারণে সবাই কানাডাকে অত্যন্ত শীতল দেশ হিসেবে জানে। সেই জানায় ভুল আছে বলছি না, কিন্তু এখানকার গ্রীষ্মের অনুভূতি আমাদের গরমকালের চাইতে নেহায়তই কম নয়। ওই যে আমাদের দেশে যার আধিক্য, ওদের দেশে তাই-ই বিরল, তাই গ্রীষ্মকে এখানকার মানুষ উদ্যাপন করে। রোদনৃত্য, সূর্যস্নান যেন তাদের বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ। শরতের শুরুতে গাছে গাছে রং ধরে। তারপর সেই রং পাল্টাতে থাকে। সবুজ থেকে হলুদ, হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে লাল। রঙের এহেন রঙিলা খেলায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাবেলা, ঠিক সূর্য ডোবার আগে, হেঁয়ালি উপত্যকা ধরে ঝর্ণার ঢালে এলোমেলো হেঁটে চলে মানুষজন। সঙ্গে থাকে অন্য কেউ, কিংবা পোষা বিড়াল নতুবা কুকুরটি। টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যায় বাইসাইকেলে চড়া স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষ। অফিস শেষে স্যুট-কোট পাল্টে শর্টস-আর টাইট সোয়েট-শার্ট পরে জগিং কিংবা সাইক্লিং এ নেমে পড়া মানুষের সংখ্যা এখানে কম নয়। আসলে সময়টাকে কাজে লাগায় তারা। শরীরটাকে ঠিক না রাখলে একটা বয়সের পরে একাকী মানুষ আরও বেশি নিঃসঙ্গতায় ভোগে। আমি থাকি টরন্টোর ডাউনটাউনে। ডাউনটাউন বেশ কেতাবি নাম। অনেকটা ঢাকার গুলশান-বনানীর মতো। বড় বড় অট্টালিকা, বার, পাব, শপিং কমপ্লেক্স, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিংবা কর্পোরেট হাউসে চাকরি করা তারুণ্যের ভিড় এখানটায়। সন্ধ্যার পর থেকে গমগম করতে থাকে প্রাণ-প্রাচুর্যে। শুক্রবার সন্ধ্যায়, সমস্ত সপ্তাহের শেষে আমি একবার ঢুঁ মারি কানাডার বাংলাপাড়া খ্যাত ড্যানফোর্থে। শরতের এ সময়টায় না আলো না আঁধারির মাঝ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে বেশ লাগে। ব্লোড় স্ট্রিতে উঠবার আগে ইসাবেলা স্ট্রিট পেরিয়ে বাম দিকে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ি শেরবর্ন স্ট্রিটে। শেরবর্ন স্ট্রিটে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। ‘শপার্স ড্রাগমার্ট’ থেকে টুকটাক ওষুধ, রূপচর্চার সরঞ্জাম কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে তাড়াহুড়ো করে বের হয় কেউ কেউ। ‘ফ্রেশকো’তে চলমান মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। তাজা শাকসবজি, কিংবা জমানো মাংসের বাহারি সামগ্রীর জন্য স্থানীয় মানুষরা এই চেইন সুপারশপে ঢুঁ মারতে পছন্দ করে। শেরবর্ন থেকে সতর্কভাবে ডানে বাঁক নিয়ে উঠে পড়ি ব্লোড় স্ট্রিটে। এই রাস্তাটি বেশ কিছুদূর গিয়ে মিশেছে ড্যানফোর্থ রোডে। তার আগে রিভারডেল পার্কে বুক চিড়ে মাটির থেকে বেশ খানিকটা ওপরে একটা প্রশস্ত ব্রিজ, সেটি সাবধানে পেরুতে হয়। এই ব্রিজে উঠলেই দেখা যাবে দুদিকে লোহার বাঁকানো তারে মুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম দেখলে মনে হবে অনিন্দ্য স্থাপত্যের নিদর্শন বুঝি। পুরনো অধিবাসীরা এতদিনে জেনে গেছেন, এই ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতে চাওয়া মানুষগুলোর কথা। তাই প্রাদেশিক সরকার এটিকে আগলে দিয়েছে। উদাসী মানুষগুলো সন্ধ্যাবেলা যাতে জীবন দেয়ার জন্য ব্রিজের প্রান্ত থেকে ঝাঁপ দিতে না পারে। এখান দিয়ে যাবার সময় আমার নিজেরই খানিকটা বিষণœ লাগে। সে কী চলে যাওয়া মানুষগুলোর হাহাকারের কথা ভেবে, নাকি সন্ধ্যাবেলার ক্রন্দনরত ঝরেপড়া পাতার শব্দে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। ড্যানফোর্থের রাস্তায় কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়বে বড় করে রাস্তার ওপরে ঝুলানো ব্যানারে লেখা ‘ওয়েলকাম টু গ্রীকটাউন’। এই এলাকাটায় গ্রীকদের আধিক্য। উৎসবমুখর গ্রীকরা খেতে খুব ভালবাসে। পুরো এলাকাজুড়ে মূল সড়কটির পাশজুড়ে রেস্তরাঁ। রাস্তার দুপাশ সঙ্কীর্ণ করে বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে মেয়রের অফিস থেকে। মানুষ সন্ধ্যার পর থেকেই জমিয়ে আড্ডা দেয়। তরুণরা বড় ‘পাইন্টে’ বিয়ার খায় আর উচ্চৈঃস্বরে হাসতে থাকে। টিভিতে চলে বেইসবল খেলা। আইসহকি আর বাস্কেটবলও দেখা যায় অনেক জায়গায়। রেস্তরাঁগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে বসার জায়গা। রোদ বা বৃষ্টি ঢাকতে মাথার ওপর বড় বড় ছাতা মেলে ধরা। একটু বেশি সন্ধ্যা হলে মধ্যবয়সী মানুষরাও আসতে থাকেন কেতা-দুরস্ত পোশাকে। ওয়াইন কিংবা শ্যাম্পেইনের ঝা চকচকে সরু গেলাসগুলো ডানা মেলে ধবধবে শাদা টেবিল ক্লথ বিছানো টেবিলগুলোর ওপরে। জানালা নামানো থাকলে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলা গাড়ি থেকেও সুঘ্রাণ পাওয়া যায় ভেড়ার গোশত কিংবা স্যামনের ভাজা চামড়ার। শুক্রবার কিংবা শনিবার রাতে গ্রীকটাউনে গাড়ি চালাতে হয় সাবধানে। স্বর্গীয় শরবতের আমেজে নিজেকে হারিয়ে খোঁজে টরন্টোর মানুষরা। লাল-সবুজ বাতির ‘নিকুচি’ করে তারা হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। গাড়ির তীব্র ব্রেকের শব্দের মাঝে মূর্ছনার মতো কানে আসে তরুণীর মুগ্ধ হাসি, ‘উপ্স, সরি। বাট ইউ নো ইউ আর আ সুইট-হার্ট, রাইট?’ এর পরে আর রাগ করে থাকা যায় না। তবে ডান পায়ের তালুটা সখ্য করে ব্রেকের সঙ্গে। চোখ সতর্ক হয়, সুন্দরীর গ্রীবায় অলঙ্কারের মতো ভালবাসা ঝুলিয়ে দিয়ে মনটাকে শক্ত করতে হয়। নতুবা পুলিশ যে কখন কোন্ অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এসে খ্যাঁক করে ধরে বসবে, বলা মুশকিল। এখানে মানুষের অধিকার সবচেয়ে বেশি। তারপর বাইসাইকেল আরোহীদের। পুলিশও জনগণের সেবক। তাই সতর্ক বাঙালী ধীরে ধীরে পেরিয়ে যায় গ্রীকটাউন। বাংলা পাড়ায় আসতে না আসতেই স্মৃতিগুলো ছেঁকে ধরে। কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক, সস্ত্রীক এসেছিলেন এখানে। ঝুম বৃষ্টির রাতে তার সঙ্গে আড্ডা হয়ে মনটা কেঁদে ওঠে দেশের জন্য। যত বড় বাড়ি বা দামী গাড়িতেই ঘুরে বেড়াক না প্রবাসীরা এই শহরটাতে, মনের গহীনে তা অচেনাই থেকে যায়। দেশের ফুটপাথ আগলে থাকা মামার দোকানে আদা চায়ের সঙ্গে পিঁয়াজু ভাজার গন্ধ কই পাওয়া যায় এই নগরীতে? তবুও অনেকে ছুটে আসে। কারও কারও না চাইতেও আসতে হয়। তারা সারা সপ্তাহ জিহ্বার চারপাশে ইংরেজী শব্দের বুলি মিলিয়ে ডলারের সংখ্যা কষে, কিন্তু সপ্তাহান্তে ঠিকই ছুটে চলে বাংলাপাড়ায়। আশা এই শরতের শেষভাগে বেশি করে চিনি দেয়া চা আর কলিজার সিঙ্গারার ভাঁজে ভাঁজে ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে ফেরা। চারদিকে সন্ধ্যা শেষে রাত্রি নেমে পড়ে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে। শীতটা একটু জাঁকিয়ে এলেই মনে হয় সোয়েটারটা গাড়িতে রেখে এসেছি। আশপাশের প্রিয় বাঙালী মুখগুলো মনে মনে বিদায় নিয়ে গাড়ির গিয়ার চলে আসে ‘পি’ থেকে ‘ডি’তে। রাস্তাগুলো হঠাৎ নদী মনে হয়। মধুমতি নদীর স্রোতের শব্দ ভেসে আসে আবেগী অন্তরে। নিজেকেই সুধাই, ‘হে বাঙালী এত আবেগী কেন তুমি?’ লেখক : গবেষক
×