ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রগতির বাতিঘর

প্রকাশিত: ২১:৪২, ৮ অক্টোবর ২০২১

প্রগতির বাতিঘর

আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে গোলাম সামদানী কোরায়শী এমন এক নাম, যাকে আমরা সব সময়ই শিক্ষক হিসেবে মান্যতা দিই। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা আমাদের মুগ্ধ করে-ঋদ্ধ করে। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, গান লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বলা যায়, একদিকে তাঁর অনুবাদ কর্ম, প্রবন্ধ এবং সিমেটিক মিথভিত্তিক উপন্যাসগুলো আমাদের সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে; সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য অনুষঙ্গ। গোলাম সামদানী কোরায়শীর আরও একটি বড় কাজ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ রচনায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে দায়িত্ব পালন। আমাদের বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ একীভ‚ত হয়ে আছে, প্রধানত আমাদের আঞ্চলিক ভাষা থেকে সেসব প্রায় অচেনা শব্দগুলোকে খুঁজে নেয়ার প্রয়োজনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ গোলাম সামদানী কোরায়শীর শরণাপন্ন হন; তাঁর আরবি ও ফারসি ভাষার উপর দখল তাঁকে এ কাজে সম্পৃক্ত হতে সহযোগিতা করেছে। তাঁর প্রতি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত হই, তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘সিন্ধুর একবিন্দু’ পাঠে। গোলাম সামদানী কোরায়শী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাংলা একাডেমিতে বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অধীনে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন বাংলা একাডেমিতে ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন। কবি সৈয়দ আলী আহসান তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক (বর্তমানে পদবি মহাপরিচালক)। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যখন সৈয়দ আলী আহসানকে প্রস্তাব করেন, সামদানী কোরায়শীকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিতে, তখনই ঘটে বিপর্যয়। আসুন আমরা গোলাম সামদানী কোরায়শীর বয়ানে শুনে নিই ঘটনাটি- ‘এর মধ্যে আবার রফিকের পোস্টকার্ড এসে উপস্থিত। সংবাদটি হলো, তোর চাকরি হয়ে গেছে। আমার গাঁটরি বাঁধাই ছিল। পরদিনই ঢাকা গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে দিনটি ছিল ২৬ ফেব্রæয়ারি। রফিককে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে গেলাম ডক্টর সাহেবের ওখানে। তিনি দেখেই বললেন, কালই একাডেমিতে এসো, তোমার নিয়োগপত্র দেয়া হবে। আমি নীরবে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। পথে রফিককে বললাম, কী হয়েছিল রে? হঠাৎ এমন নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে! রফিক বলল, বুড়ো রাগ করে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিলেন। তাই সৈয়দ সাহেব বুড়োর রাগ থামানোর জন্য তোকে চাকরি দিতে বাধ্য হয়েছেন। পরদিন ২৭ ফেব্রæয়ারি, ১৯৬১ সাল, আমি বাংলা একাডেমির আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পের সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমার নিয়োগপত্র পেলাম। আমার বেতন নির্দিষ্ট হলো ৬০০ টাকা।’ (সিন্ধুর এক বিন্দু \ গোলাম সামদানী কোরায়শী) বাংলা একাডেমিতে চাকরি পাওয়াটা ছিল তাঁর জীবনে নতুন বাতিঘর পাবার ঘটনা, সেখানেই তিনি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। সেখানে চাকরিকালেই তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্মগুলো সম্পাদন করেন। আমরা যদি তাঁর অনুবাদ সম্ভারের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তিনি অনুবাদ করেছেন- ‘কালিলা ও দিমনা’: মূল-ফার্সী, হুসায়ন আল কাশেফ-এর ‘আনোয়ারে সুহায়েল’। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৬৫); ‘হেজাজের সওগাত’: মূল ফার্সী- মহাকবি ইকবালের ‘আরমুগানে হেজাজ’, কাব্য। প্রকাশক : ইকবাল একাডেমি (১৯৬৫); ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’: মূল-ফার্সী, জিয়া উদ্দিন বারানী। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৮২); ‘তোফা’: মূল- ফার্সী, শায়ুখ ইউসুফ গদার ‘তুহফা-ই-নসাঈহ’। প্রকাশক- বাংলা একাডেমি; ‘আল-মুকাদ্দিমা’: মূল- আরবী, ইবনে খলদুন-এর ‘কিতাবুল ইবার’ প্রকাশক- বাংলা একাডেমি (দুই খণ্ড ১৯৮১ ও ১৯৮২); ‘আইন আদালতের ভাষায় আরবী ফারসী শব্দ’: মূল- ইংরেজী, ও জন বার্নস, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘অশাস্ত্রীয় পুরাণ’: মূল- ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘শব্দাদর্শ অধ্যয়ন’: মূল- মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭২); ‘আমার অভিযোগ’: প্রবন্ধ, মূল- উর্দু, সাদাত হাসান মান্টোর ‘মুঝে ভি শেকায়েত নেহী’: প্রকাশক: জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা (১৯৬৫); ‘ফতেহাবাদের আউলিয়া কাহিনী’; মূলÑ সৈয়দ ইনায়েত হুসাইন রিযভী, প্রকাশক: বাংলা একাডেমি (১৩৬৮) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বেশকিছু অনুবাদ করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন সাময়িকী এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ করতে পারিÑ সাদাত হাসান মান্টোর ছোটগল্পের নাট্যরূপ: ভেজাল; যা নাসিরাবাদ কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত (১৯৭৮); ফার্সী রস রচনা : ‘চাটনি’: সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা জেলা বোর্ড কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত; ইত্যাদির নাম। এসব গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম ছাড়াও তিনি লিখেছেন বেশ কয়েকটি সেমিটিক মিথোলজিনির্ভর উপন্যাস; স্বর্গীয় অশ্রæ (১৩৮০), মহাপ্লাবন (১৩৮৩), পুত্রোৎসর্গ (১৩৮৩) ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ: আরবী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত); সাহিত্য ও ঐতিহ্য (মুক্তধারা- ১৯৮১); ইসলাম ও আমেরিকা (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী) ইত্যাদি। তাঁর রচনার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ- আত্মজীবনী: সিন্ধুর এক বিন্দু। আত্মজীবনীতে আমরা পাই তাঁর জীবনের উত্থান-পতন, জীবন সংগ্রামের নিবিড়তম প্রিয়-অপ্রিয় নানা বাস্তবতা। আত্মজীবনী সিন্ধুর এক বিন্দু তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও আত্মজীবনীতে তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯১-এর ১১ অক্টোবর, মৃত্যু পর্যন্ত সময়টা লিখে যেতে পারেননি। কিন্তু অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীতে যে আলোর দিশা রেখে গেছেন তা-ও মহার্ঘ। বিরুদ্ধ সময়ে তিনি রচনা করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের বই (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)। লিখেছেন ‘ছোটদের দুদুমিয়া’র সংগ্রামী জীবনকথা (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থেও যে তালিকা উপস্থাপন করা গেলো, তাঁর চেয়ে দীর্ঘ তাঁর অগ্রন্থিত রচনার তালিকা। বাংলা একাডেমির কর্মজীবন শেষে তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটা সময় ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। ময়মনসিংহে অবস্থানকালে তিনি তাঁর সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক বেশি অনিবার্য হয়ে উঠলেও নিজের সৃজন ও প্রকাশনার জায়গাটিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েন; বিশেষত সৃজনকর্ম এগিয়ে চললেও গ্রন্থ প্রকাশনার কাজটিতে পিছিয়ে পড়েন। এটি তাঁর কোন অপূর্ণতা নয়, বরং এ-ও তাঁর মানুষের সঙ্গে নিবিড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণের এক বড় অধ্যায়। ময়মনসিংহের জীবনে তিনি গ্রামের বিচার সালিশ থেকে শুরু করে কবরস্থান প্রতিষ্ঠার কাজেও নিজের সময় ব্যয় করেছেন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যাপিত জীবনের প্রতিদিন মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এভাবেই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছে নিজের এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। তাঁর লেখা ‘মানুষ’ শিরোনামের ছোট্ট একটি কবিতা দিয়ে তাঁর ত্রিশতম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি- ষাট বছরে পা রেখেছি যেই অমনি ওরা বললো এসে, ‘মানুষ’ তুমি, গলায় মালা দেবো তোমাকেই। শুনে ওদের কথা বুকের মাঝে প্রশ্ন হয়ে বাড়লো নীরবতা। তাহলে কী পেরিয়ে অনেক গলি ঝেরে ঝুরে পুরনো সব কথামালার থলি যে মানুষের খোঁজে আমি এখনও পথ চলি সেই মানুষই আছে আমার মাঝে? ষাটটি বছর বৃথাই গেলো মানুষ খোঁজার কাজে? বললো ওরা, নয় তা বৃথা নয় মানুষ খোঁজো বলেই তোমার ‘মানুষ’ পরিচয়। এই না বলে পরিয়ে দিলে মালা মনে মনে বুঝতে পেলাম মানুষ হবার জ্বালা। ‘মানুষ’ সেতো পরশমণি ভাই আমি আজও মানুষ খুঁজি তাই। (মানুষ ॥ গোলাম সামদানী কোরায়শী)
×