ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

তবু সাফে সাফল্যের স্বপ্ন বাংলাদেশের...

প্রকাশিত: ০০:২২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

তবু সাফে সাফল্যের স্বপ্ন বাংলাদেশের...

লক্ষ্য একটাই-শিরোপা। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিটি আসরে অভিন্ন এ লক্ষ্য নিয়ে খেলে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু গত দেড় যুগ ধরে সঙ্গী হয়েছে শুধু ব্যর্থতাই। অংশগ্রহণের আগে বড় বড় বুলি আওড়ালেও মাঠের লড়াইয়ে বারবার অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন বাংলার ফুটবলাররা। সময়ের পরিক্রমায় আবারও দোয়ারে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ ফুটবল যজ্ঞ। এবারও অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে মিশন শুরুর অপেক্ষায় জামাল-জিকোরা। সবশেষ ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর আর শ্রেষ্ঠত্বের মুখ দেখেনি লাল-সবুজের দল। এবার দীর্ঘ ১৮ বছরের সাফল্যখরা ঘোচাতে মরিয়া বাংলাদেশ। ১ অক্টোবর শুক্রবার মালদ্বীপে শুরু হচ্ছে সাফের ১৩তম আসর। মালের ন্যাশনাল ফুটবল স্টেডিয়ামে হবে আসরের সবকটি ম্যাচ। ফাইনাল ম্যাচ হবে আগামী ১৬ অক্টোবর। সাফে বরাবরই ফেবারিটের তকমা থাকে বাংলাদেশের গায়ে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আগের ১২ আসরে মাত্র একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল-সবুজের দেশ। তাও আবার সেই ২০০৩ সালে নিজ দেশের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ১৮ বছর আগে পঞ্চম সেই আসরে ট্রফি জয়ের পর আর হাসতে পারেনি বাংলার ফুটবল। এর পরে খেলা সাত আসওে দেশের ক্রীড়ামোদীদের শুধু আপোসই উপহার দিয়েছেন ফুটবলাররা। বিশেষ করে ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে হওয়া আসরের ব্যর্থতা এখনও ভুলতে পারেননি দেশের ফুটবলপাগল মানুষ। ঘরের মাঠে তিন বছর আগের ওই আসরে নির্লজ্জ ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। ফাইনাল দূরে থাক, গ্রæপ পর্বই টপকাতে ব্যর্থ হয় স্বাগতিকরা। সেবার ভারতকে ২-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় মালদ্বীপ। এবার সেই মালদ্বীপের মাটিতেই অধরা হয়ে যাওয়া ট্রফি জয়ের মিশনে যাচ্ছেন জামাল-সাদ-জিকোরা। উপমহাদেশের অন্যান্য দলের লক্ষ্য যখন দিনের পরদিন আরও বড় হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ পড়ে আছে সাফ ফুটবল নিয়ে। আসলে উপায় তো নেই। সেই ২০০৩ সালে এসেছে প্রথম ও একমাত্র শিরোপা। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এর পরের অর্থাৎ ২০০৫ সালে পাকিস্তানে হওয়া আসরেও ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শিরোপা লড়াইয়ে আসরের সর্বোচ্চ সাতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল ২-০ গোলে। সেই শেষ, অর্থাৎ ২০০৫ সালের পর আর সাফের ফাইনালে উঠতে পারেননি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ফাইনাল দূরে থাক, গত ১৬ বছওে তো গ্রæপ পর্বের গÐিই পেরুনো সম্ভব হয়নি। বাংলার ছেলেরা শেষবার সেমিফাইনাল খেলেছে ২০০৯ সালে। ধারাবাহিক এই ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ হারিয়েছে উপমহাদেশীয় ফুটবলে পরাশক্তির আসনও। সেই গৌরব ফেরাতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এবারও প্রস্তুতির ছক কষেছে। এ লক্ষ্যে তিন বছরের পুরনো ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে’কে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্প্যানিশ অস্কার ব্রæজোনকে। যিনি বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের নতুন পরাশক্তি বসুন্ধরা কিংসে আছেন তিন বছর ধরে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই জামাল ভূঁইয়াদের নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছেন নয়া এই কোচ। বাংলাদেশের লক্ষ্যপূরণে তিনি নিজের সবটুকু নিংড়ে দেবেন বলেই জানিয়েছেন। বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া শিরোপা ছাড়া কিছু ভাবছন না। টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেন, ‘আমরা মালদ্বীপে ভাল কিছু করতে চাই। নিজেদের সেরা ফুটবলটা খেলে ফাইনালে ট্রফি স্পর্শ করতে চাই।’ জামালের জাতীয় দলে অভিষেক ২০১৩ সালে, এই সাফেই। এখন পর্যন্ত তিনি তিনটি সাফ খেলেছেন। তিনটিতেই গ্রæপ পর্বে বিদায় নিয়েছে দল। সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন এবার ফাইনাল খেলার। এ প্রসঙ্গে জামাল বলেন, ‘আমরা সঠিক অনুশীলন করেছি এবং ভাল ছন্দে আছি। আশা করি ভাল কিছু নিয়েই দেশে ফিরতে পারব।’ ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে যে কোন টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সুনির্দিষ্টভাবে খেলার ধরন নিয়ে কিছু বলতেন না। জাতীয় দলে দায়িত্ব নিয়ে অস্কার ব্রæজোন সরাসরি বলেছেন তিনি আক্রমণাত্মক ফুটবল এবং ৪-৩-৩ ছকে খেলাবেন। মাত্র এক সপ্তাহের কম সময়ে অস্কারের এই কৌশল রপ্ত করতে সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছেন জামাল, ‘জেমি ৩-৪-৩ এ খেলাতেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্লাব ৪-৩-৩ এ খেলে। নতুন কোচও সেটি খেলাতে চাইছেন। ফলে আশা করি কোন সমস্যা হবে না।’ জাতীয় দলের নতুন কোচ অস্কার প্রথম ম্যাচকে বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন, ‘আমাদের প্রথম ম্যাচ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জয় দিয়ে শুরু করলে দারুণ এক সূচনা হবে।’ ম্যাচ জিততে প্রয়োজন গোল। আর বাংলাদেশের সমস্যা স্কোরিং। দেশের ফরোয়ার্ডরা ঘরোয়া পর্যায়ে সেভাবে গোল করতে পারেন না। ফলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে এর চাপ থেকেই যায়। স্কোরিং প্রসঙ্গে অস্কার বলেন, ‘তাহলে আমাকে মাঠে নামতে হবে (হেসে)। স্কোরারদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আশা করি তারা গোল করতে সক্ষম হবে।’ কিছু দিন আগে মালদ্বীপ থেকে ফিরেছেন অস্কার। বাংলাদেশী ক্লাব বসুন্ধরা কিংস এএফসি কাপের পরের রাউন্ডে যেতে না পারলেও অপরাজিত ছিল তার দল। এরপরও তিনি শক্তিমত্তায় মালদ্বীপ ও ভারতকেই এগিয়ে রাখছেন, ‘এই দুই দলের ব্যাপারে আমার পূর্ণ ধারণা আছে। আমার সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ দলে কাজে লাগাতে চেষ্টা করব।’ প্রথম ম্যাচে র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকা প্রতিপক্ষকে পাওয়া কিছুটা স্বস্তির বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সহকারী কোচ মাহবুব হোসেন রক্সি। তবে সাফ যে বরাবরই চ্যালেঞ্জিং, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবারের আসরে অংশ নিচ্ছে সাফের অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি দেশ। দলগুলো হচ্ছে স্বাগতিক মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। এবারের আসরে খেলছে না ভুটান ও পাকিস্তান। ভুটান নিজেই টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর পাকিরা খেলতে পারছে না বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা তাদের নিষিদ্ধ করায়। মূলত ২০২০ সালে এবারের টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। তখন টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল পাকিস্তান। কিন্তু পাকিরা নিষিদ্ধ হওয়ায় নতুন স্বাগতিক বেছে নিতে হয়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে দুই দফা টুর্নামেন্ট স্থগিত করা হয়। অবশেষে মালদ্বীপে মাঠে গড়াতে যাচ্ছে টুর্নামেন্ট। এবারের আসরে চার প্রতিপক্ষের মধ্যে শ্রীলঙ্কা (২০৫তম) কেবল ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের (১৮৯তম) চেয়ে পিছিয়ে। বাকি তিন দল ভারত (১০৭তম), মালদ্বীপ (১৫৮তম) ও নেপাল (১৬৮তম) এগিয়ে লাল-সবুজদের চেয়ে। সাফে সেরা হওয়ার লড়াইয়ে বাংলাদেশ এখন আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। গেল চারটি সাফেই গ্রæপপর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। এবার পাঁচ দলের সাফ রাউন্ড রবিন লীগ হওয়ায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা ফাইনাল খেলবেন জামাল ভ‚ঁইয়ারা। কিন্তু সেই সক্ষমতা কি আছে তাদের? কি ভাবছেন ২০০৩ সালে সবশেষ সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ দলের সদস্যরা। ২০০৩ সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য হাসান আল মামুন। নিয়মিত অধিনায়ক রজনী কান্ত বর্মণ না থাকায় ফাইনালে অধিনায়কত্ব করেছিলেন মামুন। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পর তিনিই উচিয়ে ধরেছিলেন সোনালি ট্রফি। শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের সহকারী কোচ হাসান আল মামুনের কথা, ‘প্রত্যাশা থাকতেই পারে। স্বপ্ন দেখাই যায়। কিন্ত বস্তবতার হিসাবটাও মেলাতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা মাত্র দুই সপ্তাহ আগে নতুন কোচের অধীনে এবং টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন র‌্যাঙ্কিংধারী হিসেবে সাফে অংশ নেব। অথচ এমন একটি টুর্নামেন্টের আগে কোচ বদল করার সিদ্ধান্ত খুব সমীচীন মনে হয়নি।’ তিনি যোগ করেন, ‘এবার পাঁচ দলের লীগ হবে। একটি ম্যাচ খারাপ করলেও ম্যাচে ফেরার সুযোগ থাকবে। জামালরা ভাল কিছু করবে সেই প্রত্যাশা ও শুভকামনা রইল।’ ১৮ বছর আগে চ্যাম্পিয়ন দলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফরোয়ার্ড আলফাজ আহমেদ। হাসান আল মামুনের মতো তিনিও দেশের ঘরোয়া ফুটবলে কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। আলফাজের ভাষায়, ‘নতুন কোচের হাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দুয়েক ম্যাচ না গেলে আসলে বলা যাবে না বাংলাদেশ ফাইনাল খেলবে কিনা। নতুন কোচ কিভাবে একাদশ সাজায় সেটা দেখার বিষয়। নতুন কোচ হওয়ায় অনেক খেলোয়াড় একাদশে নিজের জায়গা নিয়ে খানিকটা হলেও শঙ্কিত থাকবে। জামালদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক সেই কামনাই করি।’
×