ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে সাক্ষীরা আদালতে যান না

রামু বৌদ্ধ বিহারে সহিংস হামলার বিচার শেষ হয়নি ৯ বছরেও

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

রামু বৌদ্ধ বিহারে সহিংস হামলার বিচার শেষ হয়নি ৯ বছরেও

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ বিহার, পল্লী ও মন্দিরে চালানো নারকীয় হামলার বিচার শেষ হয়নি ৯ বছরেও। সাক্ষীর অভাবে বিচার প্রক্রিয়া থমকে থাকলেও রামু-উখিয়ার বৌদ্ধদের মাঝে ফিরেছে সম্প্রীতি। অনেকে সাক্ষীকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, বিচার কার্যক্রম বিলম্ব হলেও পোড়া মন্দিরে তৈরি হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি বেড়েছে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ। ক্ষতিগ্রস্তরা পেয়েছেন নতুন ঘর। প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও ওইসব বিহার মন্দিরে এখনও নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। প্রতিরাতে দুয়েকবার টহল দিয়ে যায় পুলিশ। তবে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে রয়েছে অসন্তোষ। অপরাধীদের বেশিরভাগ আইনের আওতায় না আসায় তাদের শঙ্কাও কাটছে না। রামু প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, প্রবীন সাংবাদিক ও উত্তর মিঠাছড়ি ভাবনা কেন্দ্রে হামলা ঘটনা মামলার সাক্ষী আমির হোছাইন হেলালী জানান, ভাবনা কেন্দ্রে হামলার অন্যতম আসামি এমএম নুরুচ্ছফা সাক্ষীদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলেছে। প্রাণ ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষী দিতে ভয় পাচ্ছেন। রামু সহিংসতার ৯ বছর আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র-সাম্প্রদায়িক হামলার সেই বিভীষিকাময় দিন স্মরণে বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। দিনব্যাপী এ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে লাল চিং-মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকেলে হাজার প্রদীপ প্রজ্বলন ও সন্ধ্যায় বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা অংশ নেন বলে জানান ২৯ সেপ্টেম্বর স্মরণ অনুষ্ঠানে আহŸায়ক বিপুল বড়ুয়া আব্বু, সদস্য সচিব বিপ্লব বড়ুয়া ও অর্থ সম্পাদক রুবেল বড়ুয়া। ২০১২ সালের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রামু ও উখিয়া-টেকনাফে বৌদ্ধপল্লীতে চালানো নারকীয় হামলার ১৮ মামলার মধ্যে একটি বিচারও শেষ হয়নি। ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ীরা কেউ শাস্তি পায়নি এখনও। ঘটনার পর বিভিন্ন মামলায় ৯৯৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় আটকরা সবাই জামিনে আছে। আবার কেউ কেউ পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। ঘটনার পরপরই ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার ও ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। দীর্ঘ ৯ বছরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেকটা ফিরে এসেছে বলে জানান রামুর বৌদ্ধরা। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জনকণ্ঠকে জানান, বৌদ্ধ বিহার-মন্দির ও বসতিতে হামলার ঘটনায় সর্বমোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়। তৎমধ্যে বাদীর সম্মতিতে ১টি মামলা প্রত্যাহার হয়। অন্য ১৮টি মামলা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সাক্ষীর সহযোগিতায় বিচারকার্য ত্বরান্বিত হবে। তিনি জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সব রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী আরও বলেন, পুলিশ যদি মামলার সাক্ষীদের আদালতে উপস্থপন করতে পারে, সাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন, তাহলেই প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে। রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সাধারণ সম্পাদক জানান, রামু সহিংসতার ৯ বছর পার করছি আমরা। ঘটনার এ ৯ বছরে রামুর পরিস্থিতি অনেকটা ভাল। তবে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর কোথাও না ঘটে, এ জন্য সকলকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বৌদ্ধদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ রামুবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া জানান, রামুতে ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে, কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন জানে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেয়া সত্তে¡ও যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে, এদের অনেকেরই নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। রামু সহিংসতার মতো আর কোন ঘটনা যাতে বাংলাদেশে আর না ঘটে, সেটার একটা দৃষ্টান্ত রচিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বৌদ্ধ নেতা। উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর ১২ বৌদ্ধ বিহার, ৩০টি বসতঘর, পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে ৭টি বৌদ্ধ বিহার, ১১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়ে যায় এসব বিহার- মন্দিরে থাকা হাজার বছরের পুরাতাত্তি¡ক সব নিদর্শন। লুটপাট ও ভাংচুর করা হয় আরও ৬টি বৌদ্ধ বিহার, অর্ধশত বৌদ্ধ বসতঘরে। এ ঘটনার পর দায়ের করা হয় ১৯টি মামলা। এর মধ্যে রামুর আটটি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে রামু থানার জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়।
×