ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে ১ কোটি ৭১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে

হৃদয় দিয়ে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিন- আজ বিশ্ব হার্ট দিবস

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

হৃদয় দিয়ে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিন- আজ বিশ্ব হার্ট দিবস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাবিনা ইয়াসমিন। একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা। একটানা অফিসে বসে কাজ করতে করতে মাত্রাতিরিক্ত ওজনই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আগেই ছিল। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় দুই মাস আগে শিকার হন হার্ট এ্যাটাকের। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দুটো বøক পাওয়া গেলে চিকিৎসকরা রিং পরিয়ে দেন। আপাতত সুস্থ হলেও আতঙ্কে দিন পার করেন সারাক্ষণ। এই বুঝি আবার কোন অঘটন ঘটল। একই অবস্থা গৃহিণী শিলামনিরও। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ডায়াবেটিস কখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বুঝতেই পারেননি সংসারের কাজের চাপে। ফলাফল যা হওয়ার তাই। চলতি বছরের জুনের শুরুতে হার্ট এ্যাটাকের শিকার হন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও চিকিৎসকরা বলেছেন ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে। ৪ মাস যাবত সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে দুবার হার্ট এ্যাটাকের শিকার হলেও ধূমপান ত্যাগ করতে পারেননি উত্তম। দুইটা রিং লাগানো সত্তে¡ও প্রতিনিয়ত ধূমপান চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে আর না। চিকিৎসকরা এবার বলছেন, যতœ নিতে হবে নিজের হৃদয়ের। তবেই ভাল থাকবে হৃদয়। প্রায় ৮০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য এই রোগকে কেউ একজন চাইলেই নিজের থেকে দূরে রাখতে পারে। তাই বিশ^ হার্ট দিবসে চিকিৎসকদের আহŸানÑ যতœ নিন নিজের হৃদয়ের। বিশ্ব হার্ট ফেডারেশনের মতে, প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হৃদরোগে। প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে, যা ক্যান্সার, এইচআইভি এইডস ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়েও বেশি। করোনা সংক্রমণের দুই বছর ছাড়া প্রায় প্রতিবছরই রেকর্ড পরিমাণ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন হৃদরোগে। আর তাই হৃদরোগ ও স্ট্রোক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট বা হৃৎপিÐ দিবস পালন করা হয়। ধূমপান বর্জন, প্রতিদিন ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয় এই দিনটি উপলক্ষে। বিশে^র অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিবছর পালন করা হয় দিবসটি। ‘হৃদয় দিয়ে হৃদযন্ত্রের যতœ নিন’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালন করা হচ্ছে এ বছর। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টি দেশ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর দিনটি গুরুত্বসহকারে পালন করে থাকে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ মৃত্যুবরণ করে তার ৩১ শতাংশ হৃদরোগের কারণে। বাংলাদেশেও হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। উন্নত, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস, অসচেতনতা এসব কারণে হৃদরোগ শুধু বড়দের নয় শিশু-কিশোরদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। তাই পরিমিত খাদ্যাভাস এবং কায়িক শ্রমের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়েছে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, যেহেতু হৃদরোগের ৮০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য তাই মানুষের সদিচ্ছা জরুরী এটিকে প্রতিরোধের জন্য। তবে আমাদের মধ্যে সচেতনতার খুবই অভাব। কেউ যদি উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেই হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে না। কারো যদি মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান-এ্যালকোহলে আসক্তি থাকে তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি থাকে। তাই এসব পরিহার করা উচিত। ওজন বেশি হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কারও যদি কোলেস্টেরল বেশি থাকে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর বাকি ২০ শতাংশ যা আছে তা হচ্ছে চিকিৎসা। এক্ষেত্রে হার্টের অনেক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। এর মধ্যে রিং পরানো, এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি ও ওপেন হার্ট সার্জারির মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি। এরজন্য যে জিনিসটা জরুরী তা হচ্ছে স্বাস্থ্য বীমা। আমরা দেখছি বিশে^র অনেক দেশ তাদের মানুষকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে এসেছে। আমাদেরও প্রত্যেকের উচিত স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আসা। তাহলে বড় কোন চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে চাপ তৈরি হবে না। বিশ্ববাসীকে হৃদযন্ত্রসহ, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা ও সুস্থ জীবনযাপন শেখানোর উদ্দেশে ২০০০ সালে বিশ্ব হৃৎযন্ত্র দিবস পালন শুরু হয়। ২০১২ সালে বিশ্বনেতারা ঠিক করেন তারা ২০২৫ সালের মধ্যে হৃদরোগের মতো অসংক্রামক ব্যাধি কমাতে ভূমিকা রাখবেন। হার্টের রোগের লক্ষণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, বুকে চাপ চাপ ব্যথা, বুকের একপাশে বা বুকজুড়ে অসহ্য ব্যথা। বেশিরভাগ সময় বুকে ব্যথার তীব্রতার জন্য শরীরের অন্য অংশে ব্যথা টের পাওয়া যায় না, অনেক সময় ব্যথা শরীরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে চলে যেতে পারে। যেমন, বুক থেকে হাতে ব্যথা হতে পারে। সাধারণত বাম হাতে ব্যথা হলেও দুই হাতেই ব্যথা হতে পারে, মাথা ঘোরা, ঝিমঝিম করা ও বমি ভাব, ঘাম হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগা, সর্দি বা কাশি হওয়া। হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে করণীয় হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ আছে সেসব খাবার খেতে হবে বেশি করে। এসব খাবারের কারণে শরীরে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয় যা কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। শিম, মটরশুঁটি, ডাল জাতীয় শস্য এবং ফলমূল, আলু, মুলা, গাজর, আটা ও ব্রাউন রাইসে প্রচুর আঁশ রয়েছে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাটবাঁধা চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। এতে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ার ভয় থাকবে না। ফলে কমবে হৃদরোগের ঝুঁকি। পনির, দই, লাল মাংস, মাখন, কেক, বিস্কুট ও নারকেল তেলে প্রচুর পরিমাণ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এগুলো খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তাই। স্যাচুরেটেড ফ্যাট নেই যেসব খাবারে তার মধ্যে রয়েছে, তেলসমৃদ্ধ মাছ, বাদাম ও বীজ। আর রান্নায় জলপাই বা সূর্যমুখির তেল ব্যবহারে উপকার পাবেন। চিকিৎসকরা লবণ ও চিনি খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। লবণ বেশি খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়; যার ফলে বাড়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি। একজন ব্যক্তি দিনে ছয় গ্রাম বা এক চা চামচ লবণ খেতে পারবেন। সেই সঙ্গে কমাতে হবে চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার পরিমাণও। দেশে প্রতি ৫ জন তরুণের মধ্যে ১ জন হৃদরোগের ঝুঁকিতে ॥ বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ৫ জন তরুণের মধ্যে ১ জন হৃদরোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অবিলম্বে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা চ‚ড়ান্ত করা না গেলে ট্রান্সফাটঘটিত হৃদরোগের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তেই থাকবে। বিশ্বজুড়ে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস করতে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব হার্ট দিবসকে সামনে রেখে মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগ ঝুঁকি ও করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘হৃদয় দিয়ে হৃদযন্ত্রের যতœ নিন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বুধবার সারা বিশ্বে পালিত হবে বিশ্ব হার্ট দিবস। গেøাবাল হেলথ এ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহায়তায় বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ যৌথভাবে ওয়েবিনারটি আয়োজন করে। প্রজ্ঞার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। ওয়েবিনারে জানানো হয়, ট্রান্সফ্যাট একটি ক্ষতিকর খাদ্য উপাদান যা হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়। ডালডা বা বনষ্পতি ঘি এবং তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার, ফাস্টফুড ও বেকারি পণ্যে ট্রান্সফ্যাট থাকে। ওয়েবিনারে যুক্ত হয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিডেমিওলজি এ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল হলে তা অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আশা করছি, দ্রæততম সময়ের মধ্যে প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করবে সরকার। গেøাবাল হেলথ এ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড রুহুল কুদ্দুস বলেন, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করতে না পারলে দেশে ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়বে, চিকিৎসা খাতে ব্যয় বাড়বে এবং আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তরুণরা ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার বেশি খায়। খাদ্যদ্রব্য থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করা না গেলে তরুণ প্রজন্ম মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ খসড়া প্রণয়ন করেছে। প্রয়োজনীয় ভেটিং শেষে এটি চ‚ড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
×