ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদুজ্জামান নূর

শেখ হাসিনার সংস্কৃতি চিন্তা

প্রকাশিত: ০০:৫২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

শেখ হাসিনার সংস্কৃতি চিন্তা

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। শোকস্তব্ধ শেখ হাসিনা ফিনিক্স পাখির মতো ভস্মস্তূপ থেকে জেগে উঠছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে তিনি সংগঠনটা পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। পুনর্নির্মাণ শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণে যে আওয়ামী লীগ তখন দ্বিধান্বিত, বিভক্ত, বিশ্বাসঘাতকদের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত। বাংলার গণমানুষের নেত্রী তিনি, বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে। আমরা যারা তখন সত্রিæয় রাজনীতিতে যুক্ত নই, অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিচলিত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং দিশেহারা, চরম দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা অবলোকন করছিলাম বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সংগঠনের দুর্বলতাগুলো। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাঁর ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত প্রবহমান, তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রক্তের আরেক উত্তরাধিকারী শেখ রেহানা নীরবে সুদৃঢ় হিমালয়ের মতো মাতৃসম ভগ্নির পাশে দণ্ডায়মান। আরেক মুক্তিযুদ্ধের শুরু। সামরিক শাসন তথা স্বৈরশাসনের নিগড় থেকে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করার সংগ্রাম। শেখ হাসিনাকে আমি প্রথম দেখি যখন তিনি সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজে সহ-সভাপতির পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকবার দেখেছি কিন্তু পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটল তিনি দেশে ফেরার পর। তখন আমি নিয়মিত নাটক করি মঞ্চ এবং টেলিভিশনে। তিনি একদিন নাটক দেখতে এলেন ‘নূরলদীনের সারা জীবন’। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত এবং আলী যাকের নির্দেশিত। নাটকটি প্রায় দু’শো বছর আগের এক ঘটনা নিয়ে লেখা। উত্তরবঙ্গের এক কৃষকের সন্তান নূরলদীন হিন্দু মুসলমান সকল ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ঐতিহাসিকরা বলেন নূরলদীন এতদঅঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রবক্তা। পরবর্তীতে একপর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই নূরলদীন চরিত্রটি সৈয়দ শামসুল হক নির্মাণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদলে। নাটকটি এমন সময় মঞ্চায়িত হয়েছিল যখন জাতির পিতার নাম উচ্চারণ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। নাটকের একপর্যায়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি। তাঁর চোখে বেদনার অশ্রæ। নাটক শেষে তিনি গ্রীনরুমে এলেন কুশীলবদের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখনও বেদনামথিত। আমরাও আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। আমাদের সকলের চোখ ভিজে গেল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি এ দেশের সকল শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় আমরা মিছিলে মিটিংয়ে সামিল হচ্ছি। পুলিশের সঙ্গে মারামারি ধস্তাধস্তি চলছে। এই সময়টাতে নেত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হোল। প্রশ্ন উঠতে পারে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শিল্পীদের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি কেন? উত্তর একটাই। মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী বাদে সকল শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। পাশাপাশি শিল্পী সমাজ কখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিষয়টি ভুলতে পারেনি। মনের মধ্যে চাপা ক্রোধ, (এরপর ২৭ পৃষ্ঠায়) ক্ষোভ পুঞ্জিভূত ছিল। সে কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় উপকারভোগী এবং প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তি যে দলের গোড়া পত্তন করেছিলেন সে দলের সঙ্গে শিল্পী সমাজের কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, ওঠা সম্ভব ছিল না। আমরা প্রায়শই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম তাঁর বাসভবনে। তখন তিনি মহাখালীতে তাঁর স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সরকারী বাসভবনে অবস্থান করতেন। দু’একবার বত্রিশ নম্বরে। যতদূর মনে পড়ে সে সময়টাতে সুধাসদনে যাওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। তিনি দেশে ফেরার পর সম্ভবত ১৯৮২ সালের ঘটনা। প্রতিবারের মতো রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরন অনুষ্ঠান চলছে। আমি মঞ্চে বসা। আমার আবৃত্তি করার কথা। হঠাৎ দেখা গেল দূরে বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে নামলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে দেখামাত্র দর্শকরা যারা এতক্ষণ নিমগ্ন চিত্তে গান শুনছিলেন তাদের মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। সবাই তাঁকে এক নজর দেখতে চান। মানুষের চাপে শেখ হাসিনা মঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমি মঞ্চের ওপর থেকে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনিও হাত বাড়িয়ে দিলেন। কোনক্রমে তাঁকে টেনে তুললাম। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি সকলকে বসতে অনুরোধ করলেন। মানুষ তখন আনন্দে উল্লাসে করতালিতে ফেটে পড়ছে। কোনভাবে অনুষ্ঠান শেষ করা হোল। শেখ হাসিনা নিজেই একসময় ছায়ানটের ছাত্রী ছিলেন। গান শিখতেন। শেখ কামালও ছায়ানটে সেতার শিখতেন। শুনেছি শেখ জামালও গিটার বাজাতেন। শেখ রেহানা কবিতা লিখতেন, এখনও লেখেন। বঙ্গবন্ধু গান শুনতেন, আপন মনে মাঝে মাঝে গান গাইতেন, কবিতা, আবৃত্তি করতেন। বইও পড়তেন প্রচুর। বঙ্গমাতাও ছিলেন নিপাট বাঙালী। সবমিলে একটি বাঙালী সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে উঠেছিলেন জাতির পিতার সন্তানরা। ফলে শেখ হাসিনার সংস্কৃতি চর্চার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন নানাভাবে নানা দায়িত্বে কাজ করার সুবাদে তাঁর কাছে যেতে পেরেছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করবার সুযোগও পেয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক এবং সবশেষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি। ফলে নানা বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা সেই সঙ্গে তাঁর সংস্কৃতিভাবনা সম্পর্কে অনেকটাই জানতে পেরেছি যা আমার দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে আমাকে পথ দেখিয়েছে। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন ‘তৃণমূলে সংস্কৃতি চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রারম্ভিক জীবনে যদি শিশু সংস্কৃতির ছোঁয়া না পায় তাহলে তাদের জীবন সম্পূর্ণতা পাবে না, সুন্দর হবে না।’ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিবার শুরুতেই সবক’টি মন্ত্রণালয়ে সভা করেন। সেই সভাগুলোতে তিনি দিকনির্দেশনা দেন। সেই নিয়মে তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন। আমাকে তখন তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন আমার আজও মনে আছে- ‘শুধু অডিটোরিয়াম নির্মাণ করলে বা অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে হবে না, সংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়ে মানুষ গড়ে তুলতে হবে, যারা এই সুযোগ-সুবিধাগুলো ব্যবহার করবে। সেই কাজটি শুরু করতে হবে গোড়া থেকে। আধুনিক লেখাপড়ার চাপে শিশুদের সঠিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ আজকের দিনে এ কথাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মা-বাবা শিক্ষকদের অনবরত তাড়া-জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ পেতে হবে। ছেলে-মেয়েদের সুকোমল বৃদ্ধিগুলো বিকাশের বা প্রকাশের সুযোগ সীমিত। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘জাতির পিতা উৎসাহে বাংলা একাডেমি ১৯৭৪ সালে প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করে। বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সংস্কৃতি কর্মী এতে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু এই মহাসম্মেলনে বাঙালী সংস্কৃতির নীতি আদর্শ তুলে ধরেন। আমরা জাতির পিতার সেই নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।’ তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাই জাতীয় জীবনে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দুটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। একই বছরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালী সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে মানুষে-মানুষে মিলন হবে- এটাই বাঙালী সংস্কৃতির মূল কথা।’ ‘জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা- এসব বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। মানুষে-মানুষে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, অতিথিপরায়ণতা হচ্ছে বাঙালীর আর্দশ।’ শেখ হাসিনার এ কথাগুলো লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হাসনরাজা, শাহ আব্দুল করিম যে মানবতার গান গেয়েছেন তারই প্রতিধ্বনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও অসমাপ্ত আত্মজীবনে গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে আমি গোটা মানবজাতি নিয়েই চিন্তিত। একজন বাঙালী হিসেবে বাঙালীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। আমার এই নিরন্তর সম্পৃক্ততার পেছনে রয়েছে ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা। এই ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ জীবনকে অর্থপূর্ণ ও গভীরভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা সকলের থাকে না। আজ তাঁর সেই অমর বাণীগুলোর প্রতিফলন তাঁরই কন্যার জীবনে। শেখ হাসিনার সংস্কৃতি ভাবনার ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি বিশাল। তা নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার লেখার ইতি টানব। ২০১৫ সালে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘উৎপাদন আর সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। আমি শিল্পী সাহিত্যিকদের অনুরোধ করব, জনগণের জন্য সাহিত্য রচনা করুন। জনগণের অনুভূতিকে শিল্পে রূপান্তরিত করুন। বর্তমান সরকার আপনাদের পাশে থাকবে। আপনাদের লেখনীর একটি জাগ্রত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে।’ সংস্কৃতি সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি এক মৌলিক ভাবনা। একটি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান জাতি মুক্তচিন্তার অধিকারী হবে। তারা দায়িত্বশীল হবেন, দুর্নীতিমুক্ত হবেন সর্বোপরি দেশপ্রেমিক হবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনটাই তো চেয়েছিলেন। আজ তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক বিশাল সংগ্রামের সূচনা করেছেন। বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম। পিতার সংগ্রামে শিক্ষিত সংস্কৃতিবান জনতাই হবে তাঁর প্রধানতম শক্তি, যে শক্তি গতিময়, সৃষ্টিশীল, অপ্রতিরোধ্য। লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×