ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রসূল

তাঁর শাড়ির আঁচল আমাদের আত্মার বিবরণী

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

তাঁর শাড়ির আঁচল আমাদের আত্মার বিবরণী

আমরা বড় হয়েছি এক ভয়াবহ ইতিহাস বিকৃতির সময়ে যখন বাতাসে মিশেছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হুঙ্কার আর স্বদেশের মাটি ছিল তাদের হিংস্র নখরে বিদ্ধ, ক্ষত-বিক্ষত। আমাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত মিথ্যাচারের শকুন সময়ে। আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে ভুল ও বিকৃত ইতিহাসে ঠাসা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রচারিত কতগুলো মুখস্থ বুলি আওড়ে আমরা বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের মতোন মহাকাব্যের আয়নায় আমরা নিজেদের মুখ দেখতে শিখিনি। পঁচাত্তরপরবর্তী অন্ধকার সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি অসংখ্য প্রোপাগাণ্ডা আর মিথ্যাচার হিংস্র শ্বাপদের মতো নব্বইয়ের প্রজন্মের মগজকে ছোবল দিয়ে গেছে। আমরা বড় হয়েছি, বস্তুত কেবল বয়স বেড়েছে আমাদের-ঘাড়নিচু, মাথা নিচু আমরা কেবল ডিঙিয়েছি একের পর এক ক্লাস; জেনেছি আমাদের গর্ব করার মতো কিছু নেই, আমরা আধপেটা খাওয়া জাতি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ গজ ফিতা দিয়ে মেপে আমাদের স্বপ্ন ঠিক করে দেয়, আমরা তাদের ঠিক করে দেয়া মাপে স্বপ্ন দেখি। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই এই কুড়ি বছরের নিকষ অন্ধকার সময়ের সর্বশেষ শিকার ছিল আমাদের প্রজন্ম। খাদের কিনারায় দাঁড়ানো একটি প্রায় মরে যাওয়া প্রজন্মকে ইতিহাসের অপার আলোর দিকে টেনে এনেছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আজ ওযার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন জাতিরজনকের সন্তান শেখ হাসিনা। কী অলৌকিক সমাপতন! পরাধীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আমার পূর্ব-প্রজন্মকে স্বাধীনতার আলোর দিকে টেনে তুলেছিলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রের অন্ধকার থেকে আমাদের প্রজন্মকে সূর্যমুখী আলোর দিকে টেনে তুললেন তাঁর সন্তান শেখ হাসিনা। এখানেই রাজনীতি ফিরে আসে দর্শনের কাছে, এখানেই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের সঠিক সংজ্ঞা শিখতে পারি আমরা। তিনি যখন প্রথম বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, সাংবিধানিক ভাবে তিনি বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হলেন; একই সঙ্গে তিনি আমাদের প্রজন্মের মনোজগতের দায়িত্বটিও গ্রহণ করলেন। ধুলোমাখা, ভয়ার্ত, দিক চিহ্নহীন সন্তান কেমা যেমন অভয় দেন তিনিও তেমনি অভয় দিয়ে আমাদের মনোজগতের ধুলো-ময়লা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিলেন। আমাদের মগজের ভাঙা কম্পাসটাকে ঠিকঠাক করলেন। আমাদের হাতে তুলে দিলেন স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক। মেরুদণ্ড ভাঙা জাতি হিসেবে আমাদের গড়ে তোলার যে ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট, জাতির জনকের কন্যা সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের অমোঘ ইতিহাস দিয়ে তিনি আমাদের প্রজন্মের চিকিৎসা শুরু করলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শহুরে কিশোররা দেখলাম কী করে বাড়ির চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পাঠ্যসূচী হয়ে উঠেছিল। একটি মরতে বসা প্রজন্ম হঠাৎ জেগে উঠল টেলিভিশনের পর্দায় জাতিরজনকের সাতই মার্চের সেই অবিনাশী পঙক্তি মালা শুনে। আমরা জানলাম জাতিরজনকের তর্জনী থেকে কীভাবে রচিত হয়েছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন মানচিত্র। ইতিহাসের এই স্বর্ণখনির সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তিনি তো জানেন জনগণের রায়ে তিনি যেমন প্রধানমন্ত্রী, ইতিহাসের রায়ে তিনি তেমনি প্রজন্মের মনোজগতের পাহারাদার। তাঁর সতর্ক দৃষ্টি যেমন ছিল ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল প্রতিটি অধ্যায়ে, তেমনি তিনি আমাদের প্রজন্মের মনোজগতে রোপণ করেছিলেন রাজনীতি সচেতনতার বীজ। আমাদের তিনি শিখিয়েছেন ইতিহাস ততটাই বস্তুনিষ্ঠ, যতটা রাজনীতি ঘনিষ্ঠ। অতএব আমাদের প্রজন্মকে তিনি দাঁড় করালেন ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর তারিখের মুখোমুখি। সপ্তম জাতীয় সংসদে বাতিল হলো কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। শুরু হলো জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়া। তিনি আমাদের শেখালেন কী করে সত্য আর ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে হয়। ক্ষমতাকে মার্জিনের বাইরে রেখে কীভাবে মানুষ হিসেবে নিজের মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে স্থিারপ্রত্যয়ী থাকতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর শেখ হাসিনা জানতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রজন্ম ও তাঁকে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী ষড়যন্ত্রের জাল তো বিস্তৃত ফলে ২০০১ সালের শেষে বাংলাদেশ আবার প্রবেশ করে মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্ধকারে। স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি সারাদেশকে তখন এক মৃত্যুপুরী বানিয়েছিল। পাঠ্যপুস্তকে বা রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে কেবল ইতিহাস বিকৃতিতেই তারা সেবার ক্ষান্ত হয়নি, সমগ্র বাংলাদেশে তারা চালিয়েছে নির্মম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, বোমা হামলা আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। বাংলাদেশ তখন হয়ে উঠেছিল এক মৃত্যু উপত্যকা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জানত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণের আদ্যোপান্ত ইশতেহার শেখ হাসিনার চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি ফলে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট এই নরপশুরা পঁচাত্তরের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে উদ্যত হয়েছিল। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার শেষ কারিগর, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেনা-সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রা, আমার মতে, গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নানা ধরনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক টাল-বাহানা, আন্তর্জাতিক নানা চাপ-উপচাপ কিন্তু শেখ হাসিনা বিশ্বাস রেখেছিলেন বাংলার মানুষের উপর, ঠিকই চিনে নিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সহযোদ্ধাদের। তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেনাবাহিনী যে অমানবিক আচরণ করেছিল, তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন। তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নির্যাতনের মুখেও তিনি রাজপথে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর সহমর্মিতার কথা অকপটে জানিয়েছেন। পঁচাত্তরপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায়- ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অব্দি জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনামলটি ছিল অনেকটা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোন। বঙ্গবন্ধু সরকারের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও পররাষ্ট্রনীতির যে মহাগ্রন্থ প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা কেবল তার ভ‚মিকাটুকু আমাদের দেখাতে পেরেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি যে নির্বাচনী ইশতেহার পেশ করেছিলেন কী আশ্চর্য তাতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রজন্মের ভাষা ও ব্যাকরণ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা সেদিন আমাদেরকে এক নতুন বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছিল। সারাবিশ্বে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়া জঙ্গীবাদের ভয়াল রূপ আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এই জঙ্গীবাদকে রাষ্ট্রীয় মদদে ভরণপোষণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সমীকরণটি খুব স্পষ্ট স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, পঁচাত্তরে জাতির পিতার হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান অনুঘটক বিএনপি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২১ আগস্টের হত্যাকারীদের সমন্বয়ে এদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটেছে। আর জঙ্গীবাদের এই স্পষ্টসমীকরণে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক নানা অপশক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আমাদের বিরোধিতা করেছিল। এই জটিল সমীকরণটি প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেন বলেই তিনি জানেন কেবল একটি সমস্যার সমাধান করলেই পুরো বিষয়টির সমাধান সম্ভব নয়। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজও অব্যাহত রেখেছেন, একুশে আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলার বিচারের কাজও করেছেন এবং লক্ষ্যণীয় যে এই কাজগুলো যত ত্বরান্বিত হয়েছে, জঙ্গীবাদের প্রকোপও কমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের দিকে আজ বিশ্বে নানা দেশ তাকিয়ে থাকে। এই করোনা মহামারী সময়ে নানা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সচল রেখেছেন। প্রতিটি ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি আমাদের ঘরের মানুষ, বৈশ্বিক রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়েও তিনি আমাদের একান্ত আপনজন। তাঁর জন্মদিন তাই আমাদের ঘরের উৎসব। তাঁর সুস্বাস্থ্য মানেই মধ্যবিত্ত বাড়ির পেনশনাশ্রিত বাবার পরম নির্ভরতা, হলুদের গন্ধ লেগে থাকা মায়ের আটপৌরে শাড়ির শান্তির আঁচল। শুভ জন্মদিন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি আমাদের ইতিহাসে আদর্শলিপিকার, আমাদের জয় বাংলার অর্কেস্ট্রা। আপনার চশমার কাঁচের দিকে তাকিয়ে আমরা জাতির জনকের সেই স্বপ্নময় বাংলাদেশের পথ চিনে নিই।
×