ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

প্রকাশিত: ০০:৪০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ সমানার্থক। শেখ হাসিনা, এই বাংলাদেশের হৃদয় হতে উৎসারিত এক নাম। এই নাম যেমন রবিকরোজ্জ্বল, ঝঞ্জাজয়ী আবার জ্যোৎস্নামাখাও। তিনি স্বপ্ন দেখতে জানেন, স্বপ্ন দেখাতে জানেন, জানেন স্বপ্ন-সাফল্যের প্রকরণ ও পদ্ধতি। আদর্শে অনড়, কর্মপদ্ধতি প্রণয়নে সময় ও বাস্তবানুগ। নীতি বাস্তবায়নে নিরাপস, দৃঢ়, ঋজু এবং স্বচ্ছ। শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান। চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যে তিনি পিতার মতোই প্রত্যয়দৃঢ়, অমিততেজে উজ্জ্বলিত। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, সাফল্য, সবই আমাদের জানা। সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বলিত তাঁর জীবন। সর্বাংশে তিনি জোতির্ময় মানুষ। ঐক্যবদ্ধ মানুষের কোন পরাজয় নেই- বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা সেই চিরসত্যটি প্রমাণ করেছেন। সকল জীবনই মৃত্যর অধীন। তবে, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব/থেকে যায়...‘জীবনানন্দ দাশের এই দর্শনচেতনা আমরা উপলব্ধি করি বঙ্গবন্ধুর কর্মপরিধির মধ্যে। মাত্র ৫৪ বছর বেঁচে থাকা। আয়ুর পরিধি বিবেচনায় তাঁর কাজের ঔজ্জ্বল্য, ওজস্বিতা পর্বত চ‚ড়ার মতো। সশস্ত্র যুদ্ধপথে একটি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অবশ্যই সাহস এবং শ্লাঘার বিষয়। পাকিস্তান নামক একটি উদ্ভট রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে ২১ বছর শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাঙালীর আর কোন বিকল্প ছিল না। স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপনই নয়, এর অঙ্কুরুদ্গম, চারা, সেই চারাকে সবুজ-শোভিত বৃক্ষ করে তোলা- সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শ্রম মেধা মনন সাহস দেশপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছর পেরোল, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। বাঙালীর ইতিহাসে সূচিত হলো সূর্যডোবা দিন। ২১ বছরের শোষণ-বঞ্চনার ক্ষতিচিহ্ন, যুদ্ধদগ্ধ দেশ। নেতা নেই, ত্রাতা নেই। বঙ্গবন্ধু সূচিত অগ্রগতির চাকা শুধু স্তব্ধ নয়, ঘুরিয়ে দেয়া হলো উল্টো দিকে। অন্ধকারে যোগ হতে থাকল আরও অন্ধকার। বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা। ইতিহাসই ইতিহাসের জন্ম দেয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে । ছয় বছরের ুদুঃসহ নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে এলেন শেখ হাসিনা। কী অভ‚তপূর্ব দৃশ্য! দেশের মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কান্না একাকার হয়ে গেল। সারা দিন অঝর ধারার বৃষ্টি। বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ- মানুষে মানুষে ছয়লাব। এক ঘণ্টার দূরত্বও না। বাঁধভাঙা জোয়ার মতো মানুষে ঢেউ। অশ্রæডোবা চোখে সর্বহারা কন্যাটিকে দেখবে, দেখবে তাদের প্রিয় বোনটেকে। মানিক মিয়া এভিনিউতে হাঁটুজল। মানুষের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শেখ হাসিনার চোখের জল, সমবেত মানুষের রোদনাশ্রæ একাকার। সেদিন থেকে শুরু। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নিরলস সংগ্রামে চালিয়ে যাচ্ছন । বিরোধী দলে, সরকারে, তাঁর সংগ্রাম থামেনি। আয়না কখনও ভুল বলে না। বঙ্গবন্ধুর সেই আয়না, প্রতিফলিত হয়ে আছে বাংলাদেশের হৃদয় ছবি। শেখ হাসিনা আবির্ভ‚ত হয়েছেন আর এক স্বচ্ছ আয়না হয়ে। পিতা শেখ মুজিব বিম্বিত সেই আয়নায়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রতিচ্ছবি, তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, দেশানুরাগের বিপুলতা সবই আলো ফেলেছে শেখ হাসিনার মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী, মননশীলতার প্রতিফলন দেখতে পাই শেখ হাসিনার মধ্যে। রাজনীতিক তাঁর প্রধান পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর ধানমÐির বাড়িটি বাংলাদেশর রাজনীতির কেন্দ্রস্থান হলেও, পরিবারে ছিল সংস্কৃতি চর্চার আবহ। সমৃদ্ধ পাঠাগারে অজস্র বই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ব্যস্ততার মধ্যেও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা বই পড়তেন। হাঁড়িপাতিল, আসবাবপত্র কেনার চেয়ে তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল বই কেনায়। প্রচুর বই কিনতেন, নিজে পড়তেন, সন্তানদের পড়াতেন, কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে পঠাতেন। শেখ হাসিনার পাঠাভ্যাস ছোটকাল থেকে। তিনি ছায়ানটের ছাত্রী ছিলেন। সেতার বাজাতেন, ছবি আঁকতেন। লেখাপড়া করেছেন বাংলা সাহিত্যে। খেলাধুলার প্রতি শেখ হাসিনার ভালবাসার কথা সবারই জানা। বাংলাদেশের খেলা, বিশেষ করে ক্রিকেট। বিশ্বদরবারে আমাদের ক্রিকেটের যে সুনাম, শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ, সহযোগিতায় তা সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনার লেখক সত্তাটি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। ‘ওরা টোকাই কেন’ দিয়ে শুরু শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর কলম থামেনি। লিখে যাচ্ছন। বইয়ের সংখ্যাটি বেশ বড়। একাধিক খণ্ডে বেরিয়েছে তাঁর রচনাবলী। তিনি মূলত প্রবন্ধে লিখেন। তাঁর লেখার ক্যানভাসটি প্রসারিত এবং বর্ণিল। রাজনীতির বিষয় তো আছেই, আছে জীবনের কথা, মানুষের কথা, স্মৃতি, গ্রাম-বাংলার কথা। প্রঞ্জলা ভাষার সহজ বয়ান, নান্দনিকতায় পরিশিলিত তাঁর লেখা নতুন নির্মিতি লাভ করেছ। সাহিত্য-সংস্কৃতিবান্ধব শেখ হাসিনা, নিজেও মনন ও সৃজনশীলতার উৎস হয়ে উঠেছেন। প্রখর ব্যক্তিত্ব, সংবেদনশীলতা, সহনশীলতা তাঁর ভাবমূর্তির একদিক। নীতি, আদর্শ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি আপোসহীন। সব মিলিয়ে উজ্জ্বলিত যে শেখ হাসিনা, তা সাহিত্য-শিল্প নির্মাণের প্রেরণা। তাঁকে নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, হচ্ছে। ‘বাংলা’ কবিতা লেখায় অনুক‚ল ভাষা, ‘বাঙালী’ কবি-বৈশিষ্ট্যের জাতি। এ-ভাষায়, এদেশে লেখার সংখ্যা বিবেচনায় কবিতাই বেশি। এ কারণে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যত লেখালেখি, কবিতাই বিপুল। প্রগতিবাদী, উদার-মানবিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতায় বিশ্বাসী, প্রায় সবাই, ‘বিষয় শেখ হাসিনা’- লিখেছেন। বিষয়ের গভীরতা, সর্বজনীনতা, কালোত্তরণের বৈশিষ্ট্যে ব্যক্তি শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন শিল্পমানুষ। কবিতায় ইতিহাস লেখা, শামসুর রাহমানের কলম যথেষ্ট সিদ্ধ। পৌরাণিক প্রকরণে তিনি ‘ইলেক্ট্রার গান কবিতায় লিখছেন, ‘নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত/আড়ালে বিলাপ করি, একা একা, ক্ষতার্ত পিতা/তোমার জন্য প্রকাশ্যে শোক করাটাও আপরাধ।/ এমন কি, হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/ নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!’ স্বৈরশাসক কবলিত দেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিও নিষিদ্ধ। নৃশংসতায় স্বজন হারানো একপৃথিবী শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনা। ২০১৬ সাল, শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মবর্ষ। দিনটি উদযাপনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হলো, সৈয়দ শামসুল হক আহ্বায়ক। তখন তিনি হাসপাতালে, গুরুতর অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায় লেখা শেষ কবিতা- ‘শেখ হাসিনা সব নদীতে/ দুর্জয় গতিতে/ টেনে তোলেন নৌকা আনে উন্নয়নের জোয়ার/ শুভ শুভ জন্মদিন দেশরত্ন শেখ হাসিনার’। কবির ইচ্ছে, স্বকণ্ঠে এই কবিতা পাঠ করবেন শেখ হাসিনার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। সে আর হলো না। এর একদিন আগে সৈয়দ শামসুল হক প্রয়াত হলেন। বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সকল অঙ্গের প্রতীক হয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। রফিক আজাদের ভাষায়, ‘তিনি আমাদেরই লোক- তাঁর চোখে এদেশের/ প্রতিটি ঋতুর রঙ ধরা থাকে/ বাংলার প্রিয় মাটি-জল তাঁর নিঃশ্বাসের বায়ু’ পায়ে পায়ে বিপদ। সব জেনে সব মেনে শেখ হাসিনা অপেক্ষমাণ মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞানে অতিক্রম করে যান। দুঃখ আসে, আসে চক্রবদ্ধ ষড়যন্ত্রের ক্রোধ। তবু তাঁকে যেতে হচ্ছে, যেতে হবে আরও দূরত্বের পথে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি/ জানি, দুঃখরজনি ফুরাতে চায় না সহজে।/ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে/আপনি পা রেখেছেন মাত্র।/আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো/পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি কান্তার মরুপথ। শেখ হাসিনা আপোসহীন নেত্রী, রাষ্ট্রনায়ক থেকে হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেত্রী। শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। মুহম্মদ নূরুল হুদার কাব্যভাষ্য এ রকম, ‘সংগ্রামে অনন্যা তুমি, গণকন্যা, পরাজয়হীনা/শান্তির পতাকা হাতে তৃতীয় বিশ্বের নেত্রী হে শেখ হাসিনা।’ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পবিত্র অনলপ্রভা থেকে ফিনিক্স পাখির সৃষ্টি। গ্রীক পিরাণ অনুসারে ফিনিক্স হলো এক পবিত্র ‘আগুনপাখি’। ভস্ম হয়ে যায়। আবার সেই ভস্ম থেকে আত্মজন্ম নিয়ে প্রাণ পেয়ে শুরু হয় নতুন যাত্রা। সেই যাত্রায় রাজনীতিক শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা হয়েছেন শিল্পের মানুষ, শিল্পমানুষ। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা ভালবাসা।
×