ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রামেন্দু মজুমদার

আপনি আছেন বলেই

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপনি আছেন বলেই

শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন উদ্যাপন এক অর্থে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতির উদ্যাপন। এ উদ্যাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি উপলক্ষ- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু যেমন সমার্থক হয়ে গেছে, তেমনই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সঙ্গে আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার নাম অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। চরম এক দুঃসময়ে তিনি প্রবাস জীবন সাঙ্গ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সঙ্কটে- সাফল্যে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। এত বাধা বিপত্তির মধ্যেও বাংলাদেশ কেবল সামনে এগিয়ে চলেছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণেই। এবার নিয়ে চতুর্থ মেয়াদে তিনি সরকার পরিচালনা করছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় বিডিআর সদর দফতরে এক বিদ্রোহ ঘটিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। দেশকে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সে বিদ্রোহ সামাল দেন। ঢাকা সেনানিবাসে যখন শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ সেনা সদস্যদের সামনে ভাষণ দিতে যান, তখন অনেকেই তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পিতার মতো অসম সাহসী শেখ হাসিনা সেনা সদস্যদের সামনে গিয়ে তাঁদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়। সে হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। আসলে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে ও অগণিত মানুষের আশীর্বাদে তাঁর প্রাণরক্ষা হয়। সেই হামলার তদন্ত ও বিচারের প্রহসনও আমরা জোট সরকারের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। এবার সরকার গঠন করে শেখ হাসিনা তৃতীয় মেয়াদে সূচিত কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ইতোমধ্যে দেশে বিদ্যুত, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, শিক্ষা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতি সূচিত হয়েছে। দ্রæততম সময়ের মধ্যে টিকা আনার ব্যবস্থা করে দেশে অতিমারী মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। গ্রামের নিরক্ষর মানুষও আজ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দৈনন্দিন কার্যক্রম নির্বাহ করছে। শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ মানুষের জন্য ভালবাসা। তাঁর মানবিক গুণাবলীর জন্যেই দেশে আজ গরিব-দুঃখী মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঘোষণা করেছেন, দেশের সব মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে। তাঁর উন্নয়ন কর্মসূচীর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে গরিব-দুঃখী মানুষ। বঙ্গবন্ধু যেমন সব সময়েই চাইতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, তাঁর কন্যাও স্বাভাবিকভাবেই মানবিকতার এ দৃষ্টান্ত বুকে ধারণ করেছেন। তাঁর সকল কাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে সাধারণ মানুষের কল্যাণ। মানবিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন ১১ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে। তার জন্যে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছেন ‘মানবতার জননী’ হিসেবে। পিতার মতোই শেখ হাসিনার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ সর্বজনবিদিত। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর লেখা কথা- ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহ্রাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’ শেখ হাসিনা ছোটবেলা থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। বেগম সুফিয়া কামালের সান্নিœধ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও ছায়ানটের সাংস্কৃতিক আবহ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করেছে। ছায়ানটে তিনি শিখতেন বেহালা আর শেখ কামাল সেতার। ছায়ানটের যে বিশাল ভবন আজ প্রতিষ্ঠানটিকে একটা শক্ত ভিত্ যুগিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে তিনি তার জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বলেই। এভাবেই তিনি ছায়ানটের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। বাংলা একাডেমির অনুরোধে বেশ কয়েক বছর আমি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। একবার যখন আমি ঘোষণা করলাম যে, সেবার নিয়ে ১৭ বার তিনি বইমেলা উদ্বোধন করেছেন এবং আশা করা যায় আরও তিনবার তিনি মেলা উদ্বোধন করে একটা রেকর্ড করবেন, তিনি কথাটা শুনে চমৎকৃত হলেন, হেসে তাঁর আনন্দপ্রকাশ করলেন। বইমেলায় এলে তিনি স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠেন। ছাত্রজীবনে কত স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেরিয়েছেন মেলায়। কিন্তু এখন নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে তা আর সম্ভব হয় না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। নিজে তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। হালফিল সাহিত্যের খবর রাখেন। রোজ শোবার সময় তাঁর সঙ্গী বই। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গ খুব উপভোগ করেন। যখনই কারও চিকিৎসার সমস্যা হয়, সাধ্যমতো চেষ্টা করেন সহায়তা করতে। আমি নিজে কতজনের আবেদন নিয়ে গেছি তাঁর কাছে, কখনও নিরাশ করেননি। বেশ কিছুদিন আগে যাত্রাশিল্পী ভিক্টর দানিয়েলের চিকিৎসা সহায়তার একটা আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি বললেন, এভাবে সহায়তায় কাজ হবে না। তিনি দশ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতের ব্যবস্থা করে দিলেন তাঁর নামে। সেখান থেকে মাসে মাসে চিকিৎসার খরচটা আসবে। কতটা চিন্তা করেন তিনি মানুষের জন্য। সাম্প্রতিককালে যখনই কোন শিল্পী-সাহিত্যিকের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা তিনি জেনেছেন, তাঁর সহকারীদের নির্দেশ দিয়েছেন যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। তাঁর সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলা যায়। একবার আমার মনে আছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তিনি এসেছেন সম্ভবত সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে। আমরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছি। তিনি আমার সামনে এলে আমি বললাম, শাড়িটা তো উপলক্ষের সঙ্গে খুব ম্যাচ করে পরেছেন। তিনি হেসে তার জবাব দিয়েছিলেন। পাশে দাঁড়ানো ছিল বন্ধুবর আতাউর রহমান। ও বলল, তোমার সাহস তো কম নয়, প্রধানমন্ত্রীকে এ কথা বললে? আমি জবাব দিলাম, আমি জানি তিনি এসব কথায় কিছু মনে করবেন না। তাছাড়া তিনি আমার শ্যালিকা রাহেলার সহপাঠি ছিলেন বলে একটু ঠাট্টা করতে পারি। ফেরদৌসীকেও তিনি বড় বোনের মতো সম্মান করেন। আমি যেবার তাঁর কাছ থেকে একুশে পদক নেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেছি, আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ফেরদৌসী আপা একুশে পদক পাননি? আমি জবাব দিলাম, দশ বছর আগেই আপনি তাকে পদক দিয়েছেন। তিনি বললেন, তাইতো ভাবছি আপনার আগে তাঁর পাওয়ার কথা। আমি জবাব দিলাম, নিশ্চয়ই। সংস্কৃতির উন্নয়নে তিনি সবসময়েই আগ্রহী। গঠন করে দিয়েছেন শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট। সম্প্রতি চলচ্চিত্রশিল্পীদের জন্যও আলাদা একটি ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে। যাত্রার উন্নয়নে নীতিমালা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে অনুমতির সংকটে যাত্রাশিল্প আজ মৃতপ্রায়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ যোগান দেয়া হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে যথাযথ প্রকল্প প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। বঙ্গবন্ধুকে হারানো যেমন বাঙালীর চরমতম দুর্ভাগ্য, তেমনি সৌভাগ্য তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনাকে পাওয়া- যিনি অন্ধকার থেকে আবার আমাদের আলোর সন্ধান দিয়েছেন। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশে সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো স্বপ্নের বিশাল প্রকল্পগুলো বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন কেবল যদি আমরা আমাদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারি, তবে বাংলাদেশ সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে উঠবে। শেষ কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা সুন্দর বাংলাদেশ পাবার ভরসা করতে পারি। তিনি না থাকলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হতো? সালাহ্উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হতো? বিদেশের কত শক্তিমান নেতার অনুরোধ তিনি আমলে নেননি। আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আরও কয়েক বছর তাঁকে সরকার পরিচালনায় দেখতে চাই। তাঁর প্রাণসংহারের অনেক চেষ্টা হয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে এমন আশঙ্কা দূর করা যায় না। কিন্তু দেশের কোটি মানুষের আশীর্বাদ ও সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ তাঁর উপর আছে। আমরা বেগম সুফিয়া কামালকে অভিহিত করেছিলাম ‘জননী সাহসিকা’ বলে। শেখ হাসিনাকে আমি তাই সম্বোধন করি ‘ভগিনী সাহসিকা’ বলে। ৭৫তম জন্মদিনের শুভক্ষণে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি শেখ হাসিনা সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবী হোন্। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
×