ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পঁচাত্তরতম জন্মদিনে

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পঁচাত্তরতম জন্মদিনে

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জন্মদিনের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা জানাই। মনেপড়ে, হাই স্কুলে পা দিয়েই ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’ স্লোগানটি কণ্ঠে তুলেছিলাম। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রথম দেখি। আমাদের স্টেশনে রেলগাড়ির দরজায় হ্যান্ড-মাইকে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বই-খাতা হাতে সেই ট্রেনে উঠে পড়ি এবং সেদিনই দুপুরে জগন্নাথ গঞ্জ ঘাটে সুউচ্চ মঞ্চে গাঁদা ফুলের মালায় আচ্ছাদিত বঙ্গবন্ধুকে আবার দেখি। যমুনা নদীতে স্টিমারে করে তাঁর চলে যাবার দৃশ্য দেখি। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি- ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালীর ইতিহাস’। তারপর একটি সাদা গাড়িতে করে চলে যাবার সময় হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুকে শেষবার দেখি! বাঙালীর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ নিপতিত হয় গভীর অন্ধকারে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে চিরতরে ধ্বংস করা। বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকা বিমানবন্দরে; আনন্দে-অশ্রæতে-বৃষ্টিতে আর মানুষের হৃদয় নিঙানো ভালবাসায় সিক্ত কান্নাকাতর ও গভীর বেদনার্ত শেখ হাসিনাকে। সেদিন মুক্তির নতুন বারতা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মানিক মিয়া এভিনিউতে বর্ষণসিক্ত লাখো জনতার সমাবেশে সেদিনের ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘...আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে... বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালী জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ জাতির পিতা হত্যার বিচারের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন সেদিন। অতঃপর পাথর ছড়ানো পথে পথে তাঁর সংগ্রামী জীবনের নবযাত্রা। সেই পথে কত বাধা-বিপত্তি, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, কারা নির্যাতন, বিদেশে থেকে মাতৃ ভূমিতে ফিরতে না-দেয়ার চক্রান্ত, অসংখ্যবার হত্যাচেষ্টা- শেখ হাসিনাকে দমাতে কী করেনি মুজিববিরোধী-স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি? কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দমবার ও মাথা নোয়াবার নেত্রী নন। পিতার মতোই যা কিছু তাঁর দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয় তাই নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবেন এবং কঠিন পরিশ্রম ও একাগ্র নিষ্ঠায় তা বাস্তবে রূপদান করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে এনে মুক্তিযুদ্ধেও সপক্ষ শক্তির সরকারের নেতৃত্বদান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার; চার জাতীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাঙালী জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশকে এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছেন এবং বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উচ্চশিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। বৃত্তি ও বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে নারী শিক্ষায় অংশগ্রহণ অভাবিতভাবে বৃদ্ধি করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি-প্রশাসন-বিচার বিভাগ, সেনা-নৌ-বিমান ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে সারা বিশে^ অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করেছেন। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লব সাধন করেছেন। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রেরণ করেছেন। পদ্মা সেতু, পায়রা-সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। প্রায় শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছেন। হাজার বছরের আবহমান বাঙালী সংস্কৃতি বিকাশে ১৮৭৬ সালের ব্রিটিশ কালাকানুন-অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করেছেন। একুশে ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন;পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন, বাউল-সঙ্গীত, জামদানি ও শীতল পাটিকে ইউনেস্কোর‘ওয়ার্ল্ড ইনটেঞ্জিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকাভুক্তকরণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ উম্মুক্ত ও অবারিত করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বয়স্কদের বর্ধিতহারে ভাতার ব্যবস্থা করেছেন; জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করেছেন; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র মানুষের সুদূর স্বপ্নের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন; তৃতীয় লিঙ্গের অসহায় মানুষদের উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন; কৃষির যান্ত্রিকীকরণ-আধুনিকীকরণ করে খাদ্যে-আমিষে-পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের আনাচে-কানাচে বনজ-ফলজ-ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন। আগামী এক শ বছরের জন্য ডেল্টা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। বর্তমান বিশে^ও একজন সৎ ও সফল রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়ে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের জন্যে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করেছেন। করোনার বৈরী সময়ে কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি খাতে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা ও বরাদ্দ দিয়ে জনমানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন; অনেক উন্নত দেশ এমনকি চীনের চেয়েও অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। দেশের দরিদ্র-অসহায় মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিয়েছেন; নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্যে ন্যায্যমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সহজলভ্য করেছেন। আমাদের দেশের কবি-শিল্পী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সাধ্যমতো সহায়তা প্রদান করেছেন। এভাবে ক্লান্তিহীন ও নিরলসভাবে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মহত্ত¡ ও মানবিক গুণাবলীর ওপর দু-এক কথা আমাকে বলতেই হবে। তাঁর বিনয়ী-মিষ্টি স্বভাবে দেশে-বিদেশে সকলেই মুগ্ধ। বঙ্গবন্ধুর মতোই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের রোগে-শোকে-বিপদে-আপদে তাঁর দয়াদ্রচিত্ত যেভাবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রের উচ্চাসনে বসা কারও কাছ থেকে তা আশা করা তো দূরে থাক-কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। শুধু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নয় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট’-এর তহবিল থেকে দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করেছেন; অনেক পরিবারের ব্যয়ভার নিয়মিত বহন করছেন। কবি-লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের চিকিৎসা করানো; অসুখে অর্থ, ফলমুল-পথ্যাদি পাঠানো; কেউ মৃত্যুবরণ করলে বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সান্ত¡না দেয়া থেকে শুরু করে দাফন-সৎকারসহ সকল ব্যবস্থা নিজে তদারকি করা; পত্রিকায় খবর পড়ে অসহায় ভিক্ষুক-ভিখারিনীকে সহায়তা দেয়া; গোপনে বহুজনকে নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে যাওয়া; হত-দরিদ্র ও বিপদগ্রস্ত মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি তাঁর নিত্যদিনের মানবিক কাজের অংশ। এছাড়া জীববৈচিত্র্যের প্রতি দায়িত্ববোধ ও প্রাণিকুলের প্রতি তাঁর মায়া-মমতা অতুলনীয়। কিছুদিন পূর্বে গণভবনে গিয়ে দেখেছি-বাংলাদেশের অনেক প্রজাতির বনের পাখিদের অভয়াবাস করে দিয়ে তাদের যার যেমন খাবার-দাবার-শুশ্রƒষা প্রয়োজন সেভাবে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখলেই তারা কৃতজ্ঞতায় সমস্বরে আনন্দ ধ্বনিতে প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তোলে। এখন সারা বিশ্বময় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপিত হয়। জন্মদিন উদ্যাপিত হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের। আনন্দের বদলে সেসব জন্মদিনে আমাদের বুক বেদনায় ভরে ওঠে। গণমানুষের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার জন্মেও সময় কাছে ছিলেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডাকে দেশের প্রয়োজনে কলকাতায় গিয়েছিলেন; বিয়ের সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জয়ের জন্মের সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বন্দী ছিলেন। জয়ের জন্মের সময় বর্বর পাক বাহিনী অবরুদ্ধ বঙ্গমাতাকে হাসপাতালে কন্যার পাশে উপস্থিত হতে দেয়নি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত বঙ্গবন্ধু পরিবারের এমন জীবন কথা আমরা কি কখনও একটু গভীরভাবে ভেবে দেখি? প্রায় প্রতি দিনই জননেত্রী শেখ হাসিনার দরদি কণ্ঠে এ কথা শুনে ব্যথিত ও মুহ্যমান হই যে, তিনি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে পিতার মতোন নিজের জীবন উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত। তিনি তো সকল কিছু উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য, আমাদের জন্য। এই সেপ্টেম্বর মাসেই জন্ম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানারও। আমরা তা হলে কী দিতে পারি শেখ হাসিনাকে; শেখ রেহানাকে? একটু শ্রদ্ধা, ভালবাসা, শুভকামনা; দেশের কল্যাণে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দেয়া দায়িত্ব পালন করা; সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর আদর্শেও রাজনীতিতে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও বাঙালী সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রতীক আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, সফল রাষ্ট্রনায়ক ও সবার সুহৃদ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পঁচাত্তরতম জন্মদিনে তাঁর সুস্থতা, নিরাপত্তা ও আজীবন দেশ সেবার সুযোগ দেয়ার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি।
×