ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনী মাঠের নোংরা রাজনীতির শিকার নিরপরাধ পারুল

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

নির্বাচনী মাঠের নোংরা রাজনীতির শিকার নিরপরাধ পারুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিছক নির্বাচনী মাঠের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে নিরপরাধ পারুল বেগমকে (৪৫) নৃশংস খুনের শিকার হতে হয়েছে। প্রতিপক্ষ সদস্য প্রার্থীকে ফাঁসানোর জন্য কালো গুটির খেলা খেলছিলেন নির্বাচনী মাঠে এক প্রার্থীর সমর্থকরা। ঢাকার সাভারের বক্তারপুরে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মূল পরিকল্পনাকারীসহ তিনজনকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের চাঞ্চল্যকর এই খুনের আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। পিবিআই বলছে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে কেন দুর্বল শ্রেণীর মানুষ টার্গেট হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত। ষড়যন্ত্রকারীরা কি ধারণা করছে যে, তাদের পাশে কেউ থাকবে না? আমরা তাদের পাশে থাকব, পিবিআই থাকবে। সোমবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডির পিবিআই’র প্রধান কার্যালয় এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে পিবিআইর প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার এমন আশ্বাস দেন। পিবিআই’র প্রধান জানান, বাগেরহাটের মোংলা থানার ৬নং চিলা ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচনে ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী ছিলেন হালিম হাওলাদার, বেলাল সরদার এবং এশারাত। এই ওয়ার্ডে আগের মেয়াদে সদস্য ছিলেন হালিম হাওলাদার। তার প্রতিবেশী বেলাল সর্দার এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বলে বর্তমান মেম্বার হালিম হাওলাদার হেরে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন। তাই বেলালকে নির্বাচন থেকে সরানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেন হালিম। এরপর তিনি পূর্বপরিচিত পিরোজপুরের জামাল হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিপক্ষ প্রার্থী বেলালকে ফাঁসানোর জন্য একটি খুনের পরিকল্পনা করেন তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩০ হাজার টাকায় জামাল হাওলাদারের সঙ্গে মেম্বার প্রার্থী হালিমের চুক্তি হয়। নগদ পাঁচ হাজার টাকাও দেন তাকে। ডিআইজি বনজ কুমার জানান, ঘাতক জামাল হাওলাদার তার বন্ধু ঢাকার সাভারের দর্জি মাস্টার মশিউর রহমান মিলন কবিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার কথা মতো পূর্বপরিচিত ও কথিত বান্ধবী পারুল বেগমকে টার্গেট করেন জামাল। পারুল বেগম বাচ্চাদের জামাকাপড় তৈরি করে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। ঘাতক জামাল পারুল বেগমের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সাভারের বক্তারপুরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিতে প্রলুব্ধ করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাভারের বক্তারপুর নামাবাজার এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনা মতে, ওই রাতেই ভাড়াটে খুনী জামাল হাওলাদার তার কথিত স্ত্রী পারুল বেগমের গলায় জলপাই রঙের ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে। পরে লাশের পাশে মেম্বার প্রার্থী বেলাল সরদারের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরদিন বাসা থেকে কেউ বের না হওয়ায় ওই বাড়ির কেয়ারটেকার জানালা খুলে ওই নারীর লাশ দেখতে পান। পরে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে। লাশের পাশ থেকে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়, যেটি ইউপি সদস্য প্রার্থী বেলাল সরদারের। ওই ঘটনায় সাভার থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা হয়। পিবিআই মামলার তদন্ত দায়িত্ব পায়। জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে বেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করে পিবিআই। বনজ কুমার বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে পিবিআই’র তদন্ত দল বেলাল সরদারকে খুঁজে পায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর বেলাল খুনী নয় বলে নিশ্চিত হয় পিবিআই তদন্ত দলটি। পরে তদন্ত দল জানতে চায়, তার কোন শত্রæ রয়েছে কিনা, যে তাকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে পারে? তখন তিনি তার প্রতিপক্ষ মেম্বারপ্রার্থী হালিম হাওলাদারসহ কয়েকজনের নাম জানান। পিবিআই প্রধান জানান, তদন্ত দল জানতে পারে এ হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে হালিম হাওলাদারের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানরত একজন সন্দিগ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে খুব ঘনঘন যোগাযোগ হয়। সন্দিগ্ধ ওই ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধান করে ঘাতক জামাল হাওলাদার ওরফে সামাদুজ্জামানের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত জামালের ছবি সাভারে ভাড়া বাসার কেয়ারটেকারকে দেখালে তিনি জামালকে শনাক্ত করেন। ডিআইজি বনজ কুমার জানান, গ্রেফতারকৃত জামাল জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে। পরে গ্রেফতারকৃত জামালের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মশিউর রহমান মিলনকেও গ্রেফতার করা হয়। বনজ কুমার জানান, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এই হত্যাকাণ্ড, কিন্তু কেন। মেম্বার সামান্য একটি পদ, সেই পদের জন্য কেন এমন খুন। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে খুনী ও ভিকটিম কেউ জানে না কে খুন হবে। তারা কেবল দুর্বল দেখে টার্গেট খোঁজে। ওই নারীকে হত্যার পর জামাল ও হালিম কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে। প্রতিপক্ষ গ্রেফতার না হলে আরও খুন করার পরিকল্পনা করেছিল তারা। তাদের পরবর্তী টার্গেট ছিল একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি। সেই খুনে ফাঁসাতে পারলে বেলালকে গ্রেফতার করা সম্ভব হতো বলে ধারণা করেছিল তারা। এরই মধ্যে জামাল ও মশিউর দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তারা আদালতকে জানিয়েছেন, ইউপি সদস্য হালিমের পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকাণ্ড হয়। মূলত প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী বেলালকে ফাঁসানোর জন্যই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তবে নির্বাচনের কারণে পিবিআই হালিমকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করেনি। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর হালিমকে গ্রেফতার করে। নির্বাচনে বেলাল বা হালিমের কেউ জেতেননি। জয় পেয়েছেন তৃতীয় প্রার্থী এশারাত নামের ব্যক্তি।
×