ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার

সার্চ কমিটিই উপায় ॥ ইসি গঠনে এই মুহূর্তে আইন তৈরির সুযোগ নেই

প্রকাশিত: ২২:০৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

সার্চ কমিটিই উপায় ॥ ইসি গঠনে এই মুহূর্তে আইন তৈরির সুযোগ নেই

নতুন আইন প্রণয়ন করে সেই আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো পর্যাপ্ত সময় এখন সরকারের হাতে নেই। আইনের খসড়া প্রণয়ন এবং তা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংসদে উত্থাপন করে তা দিয়ে ইসি গঠন অন্তত দুরূহ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতে নির্ধারিত সময়েই ইসি গঠনের নিয়ম রয়েছে। আর ইসি গঠনের জন্য বর্তমানে প্রচলিত সার্চ কমিটি গঠনও আইনসিদ্ধ। তাই সময়ের অভাবে ফের সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠনে সরকারকে হাঁটতে হচ্ছে। যদিও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকের একটি অংশ সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের বিরোধিতা করছেন। তবে সরকারী দল বলছে, বর্তমানে ইসি গঠনে প্রচলিত বিধিও আইনসম্মত। আইন মেনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইসি নিয়োগকে আইনসিদ্ধ অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের বিভিন্ন শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইন অর্থ- কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনী ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি। এখানে ‘বিজ্ঞপ্তি’-কে আইন বলা হয়েছে। সার্চ কমিটিও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কারণে এই বিজ্ঞপ্তিই আইন, এমনটাই বলছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সাড়ে চার মাস মেয়াদ রয়েছে। তাদের মেয়াদ পূরণের পর নতুন ইসির জন্য আগামী জানুয়ারি মাসে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটির বাছাই করা নামের তালিকা থেকেই সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে দায়িত্ব নেবেন নতুন ব্যক্তিরা, যাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। ইসি গঠনে আইন বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক বলেন, আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেয়ার জন্য আইন করার কথা বলা আছে। কিন্তু ইসি গঠনের আইনটি সরকার এখনও করতে পারেনি। আমরা অবশ্য আইন করার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে আইন করে ইসি গঠনের মতো পর্যাপ্ত সময় সরকারের হাতে নেই। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, যেহেতু আমাদের আইন নেই, তাই ইসি গঠনে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করে থাকেন। এটাও আইনসিদ্ধ। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি সবসময় সিইসি ও ইসি নিয়োগ দিলেও গত ২০১২ সালে কমিশন হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। ওই সময় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির; সংবিধানে বলা আছে, একটি আইনের অধীনে তিনি এই নিয়োগ দেবেন। সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন ঠিক করে দেবে না, তারা রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করতে কিছু নাম বাছাই করে দেবে। রাষ্ট্রপতি তা থেকে নিয়োগ দেবেন। স্বাধীনতার পর ১২ সিইসি ও ২৭ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন। এদিকে ইসি গঠনের সময় যতই এগিয়ে আসছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন মহল থেকে আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হচ্ছে। শনিবার ৫২ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন আইন করে গঠন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যাকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বলছেন, সার্চ কমিটিও একটি আইনী প্রক্রিয়া। আওয়ামী লীগ নেতারা আরও বলেন, সার্চ কমিটি গঠন করে ইতোমধ্যে দুই দফায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটির মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করায় কোন মহলই ‘আজিজ মার্কা’ নির্বাচন কমিশন হয়েছে এমন কথা বলতে পারেনি। তাই দুই দফায় যেভাবে সার্চ কমিটি করা হয়েছে এবারও সেভাবেই নতুন কমিশন গঠন করা হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, সার্চ কমিটিও আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়ে আসছে। এই পদ্ধতিটা আইনে পরিণত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে সরকার। আইন মেনে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশে কমিশন নিয়োগ দেয়া হয়। এটি সংবিধান সম্মত। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকলেও বর্তমানে সরকারের হাতে সেই সময় নেই। কারণ, বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হবে আগামী মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের দুটির বেশির অধিবেশন সম্ভব হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন ইসি গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করতে গেলে প্রাথমিকভাবে আইনের খসড়া তৈরি করতে হবে। সেই খসড়ার ওপর মতামত যাচাইয়ের জন্য ভেটিংয়ের আয়োজন করতে হবে। বিভিন্ন পক্ষের মতামতের পর যাচাই-বাছাই করে বিধিমালা আকারে তা প্রণয়ন করতে হবে। পরবর্তীতে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের পর জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে হবে। সেই আইনটি বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষের মতামতের পর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে আইনে পরিণত করতে হবে। নতুন আইন করতে গেলে পুরোটা একটি জটিল প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। আর এটি সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন হবে। আগামী ইসি গঠনের আগে যেটি কল্পনাতীত। বিশেষজ্ঞরা ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিলেও আগামী ইসি গঠনের ক্ষেত্রে তা প্রণয়ন করা কঠিন বলেও মত দেন। তাই আগামীতে সময় নিয়ে আইনটি প্রণয়নের দাবিও তারা জানিয়েছেন। সরকারও আগামীতে দ্রুত সময়ে এই প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে আপাতত সময়ের অভাবে প্রচলিত সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠন করা হবে বলেও ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে। সরকারী দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসি গঠনে এমন আভাসই দেয়া হচ্ছে।
×