ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মাহবুব আলী

উন্নয়ন ভাবনা ও পর্যটন

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

উন্নয়ন ভাবনা ও পর্যটন

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সত্তার দুটি নাম। সকল অর্থে তিনিই বাংলাদেশ। জীবনভর তিনি দেশ ও মানুষের মুক্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা ভেবেছেন। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বাঙালীর দুঃখ, বেদনা, আনন্দ ও স্বপ্নকে তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নাগপাশ থেকে মুক্ত করে তিনি আমাদের শুধু একটি দেশই উপহার দেননি; সদ্য স্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছেন। যে কোন দেশপ্রেমিক বাঙালীর চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জাতির পিতার হাত ধরেই বাংলাদেশে পর্যটনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশের স্বার্থে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। পরবর্তীতে পর্যটনের আকর্ষণীয় স্থানসমূহ চিহ্নিত করে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের ক্রমবর্ধমান অবদানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড গঠন করেন। পর্যটনের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রস্তুত হয়েছে পর্যটন মহাপরিকল্পনা। এই মহাপরিকল্পনার ফলে দেশের পর্যটন শিল্পের গুণগত মানের হবে উন্নয়ন। পর্যটনের বিকাশের সুবিধার্থে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে স্থায়ী ঠিকানা ‘পর্যটন ভবন’ নির্মাণ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন ভাবনা ছিল যুগের থেকেও আধুনিক। তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন উন্নয়ন ও প্রকৃতির সুরক্ষা পাশাপাশি পথ চলতে পারে। পরিবেশের সুরক্ষার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশ অর্থাৎ, সাম্প্রতিককালে যা ‘ইকো ট্যুরিজম’ নামে পরিচিত, সেটির প্রবর্তন বাংলাদেশে হয়েছে জাতির পিতার হাত ধরেই। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গর্ব পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের পরিবেশের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তৈরি করেছেন ঝাউবন। সামাজিক বনায়ন ও উপকূলীয় বনাঞ্চল তৈরির সূচনাও হয়েছিল জাতির পিতার হাত ধরেই। তিনিই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন সবুজ প্রকৃতি পর্যটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১ কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। আমাদের দেশেও পর্যটন খাতে এখন পর্যন্ত মোট কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৩২ হাজার মানুষের। দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জাতীয় আয়ে পর্যটন খাতের অবদান জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু যুগান্তকারী কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনার কারণে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে ভাল করছে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যাান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের ২০১৯ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরে পর্যটন খাতে দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। প্রতিবেদন অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জিডিপি-তে পর্যটনের অবদান হবে ৬ শতাংশ। সব সূচকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৮তম। পর্যটন উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের অনেক সেক্টরের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। পর্যটন উন্নয়ন হলে পরিবহন সেক্টর, হোটেল মোটেল, রেস্টুরেন্ট, কার পণ্য ইত্যাদি বিকশিত হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গ্রামের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনের উন্নয়ন। তিনি আজীবন প্রান্তিক মানুষের অধিকার ও উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। গ্রামের সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত পর্যটন উপাদান চিহ্নিত করে তা উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন ও গ্রামের প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে একটি করে গ্রোথ সেন্টারে, যা সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পর্যটনের উন্নয়নে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। দেশে পর্যটনের বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তিনি। পর্যটকদের যাতায়াতকে সহজ, দ্রুততর ও আরামদায়ক করতে এবং তাদের আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান করতে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে দেশের সকল বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ২১ হাজার ৩ শত ৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ৩য় টার্মিনাল। নান্দনিক সৌন্দর্যের ৩য় টার্মিনালে অবকাঠামোগত সকল সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সকল দেশী-বিদেশী যাত্রী এই টার্মিনালের মাধ্যমে ভ্রমণকালে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এছাড়াও ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ে শক্তিশালীকরণ ও এয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ২ হাজার ৭ শত ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প চলমান। কক্সবাজার ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার কাজও চলছে। ৫ হাজার ১ শত ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এর দৈর্ঘ্য ৯০০০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১০,৭০০ ফুট করা, নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ, এয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজও চলমান। এই বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ সমাপ্তির পর আঞ্চলিক হাবে পরিণত হওয়ার কারণে কক্সবাজার প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের জন্য পর্যটন স্বর্গে পরিণত হবে। এছাড়াও দেশের ভিতরে পর্যটকদের জন্য সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কক্সবাজারের গুংধুম পর্যন্ত রেল লাইন এবং প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় নেতৃত্বে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের গভীরতম ভিত্তির ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্র্ঘ্যরে পদ্মা সেতু। পর্যটনের প্রসারে সহায়তা ও বহির্বিশ্বে দেশের গৌরবময় পদচারণা নিশ্চিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গড়ে তোলেন রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠান বিকশিত হচ্ছে তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য ক্রয় করেছেন বিশ্বের অত্যাধুনিক সব উড়োজাহাজ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সফলতার ন্যায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও আমরা সফল হব। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কাজ করছে করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন ৬টি সংস্থা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষে’ আমাদের অঙ্গীকার বাংলাদেশের গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে পর্যটন হবে অন্যতম মাধ্যম। পর্যটন বেকারত্ব হ্রাস, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাংলার গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ উন্নয়ন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনকে প্রতিফলিত করবে। লেখক : এমপি, প্রতিমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
×