ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের এসডিজি পুরস্কার

প্রকাশিত: ২০:২০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের এসডিজি পুরস্কার

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার প্রদানে ভূষিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এ পুরস্কার গ্রহণ করে বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণকে এটি উৎসর্গ করেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (এমডিজি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) দ্রুত এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এ পুরস্কার পাওয়াকে দেশের সফলতার গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে অভিহিত করা যায়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন কৌশলবিদ অধ্যাপক জেফ্রি ডি. স্যাক্সের নেতৃত্বে জাতিসংঘ মহাসচিবের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সালে এসডিএসএন প্রতিষ্ঠা করা হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য বাস্তবভিত্তিক সমাধান জোরদারে বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানোই এ প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য। উল্লেখ্য, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যের (এসডিজি) গোল ১৭টি, টার্গেট ১৬৯টি ও ইন্ডিকেটর ২৩২টি। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন অব দি ডে’ হিসেবে তুলে ধরেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালেও এসডিজি প্রচার কার্যক্রম চালাতে তার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন ‘এ পুরস্কার হচ্ছে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে জোরালো দায়িত্ব পালনের একটি প্রমাণপত্র।’ আর্থ ইনস্টিটিউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক সম্মেলনটির আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী বিগত ২১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার টেকসই উন্নয়নের ওপর নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভার্চুয়ালি বক্তব্য প্রদানকালে তার বক্তব্যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা রেখেছেন, যাতে এসডিজি অর্জন নিশ্চিত করতে যথাযথভাবে বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করা যায়। যেমন- প্রথমত- ‘এই বৈশ্বিক মহামারী থেকে টেকসই উত্তরণের ওপরেই এখন এসডিজির সাফল্য নির্ভর করছে। এখন বিশ্বের সব স্থানে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা সময়ের দাবি এবং তা অতি জরুরী; দ্বিতীয়ত- ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমাদের সম্পদের যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, তা অবশ্যই কমাতে হবে; তৃতীয়ত- চলমান বৈশ্বিক মহামারীর অভিঘাতের কারণে ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। অধিকন্তু আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনীর ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে; চতুর্থত- এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি সাহসী ও উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে কেউ পেছনে পড়ে না থাকে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের বিপর্যয় বা দুর্যোগ মোকাবেলায় জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণকে পূর্ণতা দেবে; পঞ্চমত- এসডিজি বাস্তবায়নে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ জোরদার করা ও যান্ত্রিক সহায়তার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ‘সবুজ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন, লবণাক্ততা সহিষ্ণুতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট- ২০২১ এর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে এসডিজি সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে এ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন প্রচেষ্টায় পথিকৃৎ। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে প্রথম পাঁচটি দ্রুততম অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশের মধ্যে অন্যতম এবং জিডিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। জাতিসংঘ এ বছর বাংলাদেশকে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালায় এজেন্ডা ২০৩০ অঙ্গীভূত করতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, দেশ ইতোমধ্যে ২০১৭ এবং ২০২০ সালে দুটি ভিএনআর জমা দিয়েছে। বাংলাদেশের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক মূল্যায়ন এবং সমন্বিত এসডিজি করেছি, যা দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যআয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরিত করার কল্পনা করছে। ডেল্টা-প্ল্যান ২১০০ গ্রহণে এসডিজি ভিশন করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপক বদ্বীপ তৈরি করা। ডিজিটাইজেশন ও সংযোগে বাংলাদেশ বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, তরুণদের নেতৃত্বে উদ্ভাবন এবং রূপান্তরমূলক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করেছে। এটি দেশের কোভিড-১৯ মহামারীকে আরও ভালভাবে মোকাবেলা করতে সহায়তা করছে। ডিজিটাল অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সর্বাধিক সুবিধা পেতে যুবকদের সহায়তা করার জন্য তাদের শিক্ষা এবং দক্ষতা বিকাশে প্রচুর বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ডব্লিউইএফের মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ৭ম স্থানে রয়েছে, যা ২০১৪ সাল থেকে তার আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে। নারী শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা বাংলাদেশে বিনামূল্যে করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ উপবৃত্তি পাচ্ছে এবং উপবৃত্তির অর্থ সরাসরি তাদের মোবাইলের মাধ্যমে বা বৈধ অভিভাবকদের কাছে পৌঁঁছায়। প্রধানমন্ত্রীর এই সময়ের অর্জন জাতিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার একটি সফল প্রয়াস, যা জাতির জন্য গর্বের বিষয়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক দফতর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলদেশে ২০১৬ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত আনুমানিক ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন হবে, যা গড়ে বার্ষিক ৬৬.৩২ বিলিয়ন ডলার, যা একই সময়ের জিডিপির ১৯.৭৫শতাংশ। এই ৬৬ বিলিয়নের মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন ৮৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক অর্থায়ন ১৫ শতাংশ পাওয়া যাবে। দেশীয় অর্থায়নের মধ্যে সরকারী, বেসরকারী ও অংশীদারিত্বে হবে যথাক্রমে ৩৩.৫, ৪২ এবং ৫.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রারম্ভিকভাবে সফলতা দেখিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- দারিদ্র্য হ্রাস, ক্ষুধা হ্রাস, ৫ বছরের কম বয়সী মৃত্যুহার, নবজাতক মৃত্যুহার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক- উভয় শিক্ষাস্তরে সফলতা এবং লিঙ্গ সমতা। বিদ্যুতের ব্যবহার এখন প্রায় ৯৯ শতাংশের ওপরে। কর্মরত প্রত্যেক ব্যক্তির প্রকৃত জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে এবং জিডিপির অনুপাত হিসেবে উৎপাদন মূল্য সংযোজন বৃৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেট বরাদ্দ এবং অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সফলতার প্রথম চালিকাশক্তি হলো সরকারের সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রত্যয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দরিদ্রবান্ধব ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনা, টেকসই জিডিপি বৃদ্ধি, আয় নির্ভরতা অনুপাত হ্রাস, মৃত্যুহার হ্রাস, উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, নারী শ্রমশক্তির বর্ধন, রফতানি প্রবৃদ্ধি, অভিবাসী শ্রমিকদের অর্থ প্রেরণ, আইসিটির বহুমাত্রিক ব্যবহার ইত্যাদি। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব হচ্ছে- নারীর ক্ষমতায়ন, আশ্রয়ণ (গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসন) প্রকল্প, শিক্ষা সহায়তা, আমার বাড়ি আমার খামার, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিনিয়োগ উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী এবং সকলের জন্য বিদ্যুত। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ এবং ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত এক দশকে এমন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে যে, করোনাকালে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। আশা করি, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হবে প্রায় ছয় হাজার ডলার এবং ২০৪১ সালে হবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার। সরকারের এই সকল পদক্ষেপ জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে নিশ্চয়ই। জাতিসংঘের এসডিজি বাস্তবায়নের পুরস্কার দেশ ও জাতি গঠনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল বহুলাংশে। লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
×