ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আমজাদ খান

স্মরণ -শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

স্মরণ -শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন

দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষার জন্য এবং ধাপে ধাপে মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আমাদের ঋণী করে গেছেন, দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রেই ইবনুল আরাবীর উপরোক্ত মন্তব্যটি প্রযোজ্য, শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন তাদেরই একজন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে। ১৯৬২-৬৩ সালে শহীদ ময়েজউদ্দিন ঢাকা পৌরসভার অধীনে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্রী (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার পরে তিনি এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক সহযোগিতা করেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে। তখন শহীদ ময়েজউদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’ এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। শহীদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপোস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সব ভ-ুল করতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করেন কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে। সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভোটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেন- ‘কোন ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোন নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই উঠে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনীচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেন- ‘খন্দকার মোশতাক আহমেদ অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোন নেতৃত্ব মানি না, সে খুনী, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ তার কোন নেতৃত্ব মানতে পারে না।’ তিনি যখন এই বক্তব্য দেন তখন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা অস্ত্রহাতে পেছনের সারিতে দাঁড়ানো। বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মুহূর্তে তার মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল শতভাগ। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। বক্তব্য শেষ করে অস্ত্রধারীদের ভয়ে তিনি বাসায় না ফিরে কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ঘটনা। জেনারেল আইয়ুব খানের আহ্বানে পূর্ব বাংলার নেতৃস্থানীয় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানে যান রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য। তাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ মুহূর্তে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ময়েজউদ্দিনকে বললেন, তুমি লাহোর থেকে আজই করাচী দিয়ে দেশে গিয়ে এই চিরকুটটি বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নিকট পৌঁছিয়ে দেবে এবং বলবে তিনি যেন অতিসত্বর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর নিকট চিরকুটটি পৌঁছিয়ে দেন। তখনই তিনি দেশে রওনা হয়ে গেলেন। ঢাকা কমলাপুর এসেই বেবীটেক্সিযোগে তিনি বেগম মুজিবের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। এই হলো শহীদ ময়েজউদ্দিন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বেকসুর খালাসের পর লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে যে দশজন নেতা উপস্থিত ছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ময়েজউদ্দিন ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফপিএ বি-র মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। IPPF mn IOR-এর সদস্য ছিলেন। জবীবড়-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ’৮০-এর দশকেই এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তখনই তিনি কালীগঞ্জে নিজ জায়গায় ৩টি মাতৃ সদন স্থাপন করে গেছেন। ওই একই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া শহীদ ময়েজউদ্দিন বহুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজধানীর রাজপথ থেকে কালীগঞ্জের রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জে সামরিক শাসকের দোসররা ততদিনে উপলব্ধি করতে থাকে যে, ময়েজউদ্দিনের উপস্থিতিতে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কালীগঞ্জের ক্ষমতায় আসার জন্য সামরিক শাসকের সঙ্গে ময়েজউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য ময়েজউদ্দিন নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সমগ্র দেশব্যাপী ২২ দল আহূত হরতাল চলছে। কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আর তখনই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া আজম খান ও তার পালিত সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। কালীগঞ্জের রাজপথ তার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের এই হত্যকান্ড সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশে তার হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্রনিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৫ সালে ৫ আগস্ট ঢাকা জজকোর্ট থেকে খুনীদের যাবতজীবন কারাদন্ডের রায় ঘোষণা করা হয়। রায় ঘোষণার দিন কোর্টে শত শত উকিল এবং জনতা উপস্থিত ছিল। বাহিরে অবস্থানরত শহীদ ময়েজউদ্দিনের ছোট ভাই কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমানে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম এবং তার সঙ্গে দাঁড়ানো এ্যাডভোকেট আমিনুল হককে (সার্জেন্ট জহিরুল হকের ভাই) লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়। বোমাটি জজকোর্টের পিলারে লেগে নিচে পড়ে যায় এবং রায় শুনতে আসা শহীদ ময়েজউদ্দিনের বিশেষ ভক্ত পিরোজপুর রেড ক্রিসেন্টের ইউনিট সেক্রেটারি ধীরেনবাবুর হাঁটু থেকে দুই পায়ের নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ উড়ে যায়। আজম গংদের ছোড়া ওই বোমা হামলারও কোন বিচার হয়নি আজও। খুনীদের বাঁচাতে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে। আদালতের দন্ড খুনীরা যদি এড়াতে পারলেও মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কারের দন্ড এরা এড়াতে পারবে না। সেই ধিক্কারের আগুনে পুড়ে পুড়েই এদের অভিশপ্ত জীবন একদিন শেষ হবে। তবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়। কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের নিকট তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ এর পৃষ্ঠা ১০৮-এ লিখেছেন ‘ময়েজউদ্দিন, তিতাস, রমিজ, বাসুনিয়া, চন্নু এমনি হাজার আত্মাহুতির প্রয়োজন হলো গণতন্ত্রের জন্য অধিকারের লড়াইয়ে।’ গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেয়া শহীদ ময়েজউদ্দিনের কথা স্মরণ রেখেই হয়ত প্রধানমন্ত্রী ময়েজউদ্দিনকন্যা মেহের আফরোজ চুমকীকে ১৯৯৬ সালে গাজীপুর-নরসিংদী জেলার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি মনোনীত করেছিলেন। পরবর্তীতে নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি পর পর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং দুইবার দক্ষতার সঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আজ ৩৭তম শাহাদাতবার্ষিকীতে শহীদ ময়েজউদ্দিনসহ সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা
×