ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্লাস্টিকে অশনি সঙ্কেত ॥ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

প্লাস্টিকে অশনি সঙ্কেত ॥ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর

শরীফুল ইসলাম ॥ প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর। তারপরও এর ব্যবহার দিন দিনই বাড়ছে। একদিকে অধিক মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীরা প্লাস্টিক পণ্যের বাজার প্রসারিত করছেন অপরদিকে অপেক্ষাকৃত কম দামে সহজে হাতের নাগালে পাওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ তা দেদারছে কিনছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এর বিরূপ প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, এ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষসহ সমগ্র জীবজগত। তাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক না হলে রয়েছে মহা বিপদের শঙ্কা। প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে ফেললে পচে না, গলেও না। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দেয়ার পর তা থেকে যায় অনন্তকাল। প্লাস্টিকদ্রব্য এবং এর উপজাত, কণিকা বা নিঃসরিত অণুর সংযোজন জল ও স্থলে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছড়ায়। এর ফলে মানুষসহ পুরো জীবজগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, মাটি ও পানিতে খাদ্যচক্রের প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক নিঃসৃত ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থও মিশে যায়, যা খেয়ে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবুও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় বিক্রয় মূল্যও কম। এ ছাড়া এসব পণ্য ওজনে হাল্কা এবং সহজে বহনযোগ্য। তাই মানুষ ঘরে-বাইরে বিভিন্ন কাজে এই পণ্য ব্যবহার করেন। কিন্তু এসব পণ্য যখনই নষ্ট হয়ে যায়, তখনই যত্রতত্র ফেলে দেয়া হয়। বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। বিশ্বে প্রতি বছর ৩৮১ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হয়। এ বর্জ্যরে ৫১ শতাংশ এশিয়া মহাদেশে। অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যরে সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা এবং বিসফেনলসহ নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে নির্গত হয়। এসব মাইক্রো ও ন্যানো কণা এবং নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের হরমোনাল সিস্টেম নষ্ট করতে পারে। ফলে প্লাস্টিক দূষণ মানুষ ও অন্যান্য জীবের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে নানা রকম দূরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে। এছাড়া প্লাস্টিকের ন্যানো কণা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের কোষাভ্যন্তরের ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে পরিবর্তন করে দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার বা স্নায়ুতন্ত্র বিকল করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে প্লাস্টিক এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারছেন না এটি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। যেসব প্লাস্টিক পণ্য মানুষ ব্যবহার করে, সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। দেশে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় ১৫ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৩৪ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্বে মাথাপিছু গড়ে ব্যবহৃত হয় ৬০ কেজি প্লাস্টিক। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজির বেশি। এসব পণ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের পাত্রে রেখে কিছু খাওয়া ও প্লাস্টিকের বোতলের পানি পান করা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলেও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। ফলে ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি, এ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা ও গর্ভপাতসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, প্লাস্টিকের কারণে সৃষ্ট দূষণ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। তবে মানুষকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। ব্যবহারের পর যেখানে সেখানে প্লাস্টিক পণ্য ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে রাজধানী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন নদীর বেহাল দশা। বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে এখন প্লাস্টিকের কয়েক ফুট স্তর। এর ফলে এই নদীর পানি এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। এই দূষিত পানিতে মাছসহ অনেক প্রাণীর দেখা মিলছে না। আর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে নদীর তলদেশ থেকে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর প্লাস্টিক সরানোও যাচ্ছে না। এর ফলে নদীটির নাব্য অনেক হ্রাস পেয়েছে। ভয়ঙ্কর ক্ষতির মানুষের ব্যবহার্য প্লাস্টিকের অধিকাংশের শেষ গন্তব্য সাগর। প্লাস্টিক কখনই পচে না। আর কোন কারণে পচলেও তা মাটিতে মিশতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর লেগে যায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় নদ-নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের একটি বড় অংশ ভাসতে ভাসতে নদী থেকে সাগরে পতিত হয়। এ ছাড়া কিছু অসচেতন পর্যটক সমুদ্র তীরে প্লাস্টিক পাত্রের বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারের পর খালি পাত্র পানিতে ছুড়ে ফেলেন। সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ ও ট্রলার থেকেও প্লাস্টিক পণ্য পানিতে নিক্ষেপ করা হয়। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সময় স্থলভাগের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সাগরে পতিত হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, সারাবিশে^ প্রতি বছর ১৬ কোটি ৫০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পতিত হয়। সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত পতিত হয় বছরে অন্তত ১০ কোটি টন। যার ৮৫ শতাংশই ভূমি উৎস থেকে পতিত হয়। সাগরে বর্তমানে ৫ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক কণার সংখ্যা বেশি হবে। বর্তমানে প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে ৫০ হাজার প্লাস্টিক টুকরা জমা রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হিমালয় পর্বতও রক্ষা পাচ্ছে না। এর ক্ষতি থেকে কোন দেশ বা অঞ্চলই রক্ষা পাচ্ছে না। যেসব দেশ প্লাস্টিক পণ্য বেশি উৎপাদন বা ব্যবহার করে তারা এবং যেসব দেশ উৎপাদন ও ব্যবহার কম করে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পায় না। সমুদ্রবিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব মিহির বিশ্বাস জনকণ্ঠকে জানান, প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের কারণে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত দূষিত হচ্ছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর রয়েছে। বিভিন্ন নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে প্লাস্টিক। এর ফলে সাগরে এখন মাছের চেয়ে প্লাস্টিক কণাই বেশি। এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে বছরে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করতে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এতে ব্যাপক গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিক থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব যে কোন উপায়ে মানবদেহে পড়তে পারে। যেমন প্লাস্টিকের কারণে মাটি দূষণ হলে ওই মাটিতে বেড়ে ওঠা গাছ থেকে সব্জি বা ফলমূল খেয়ে রোগবালাই হতে পারে। একইভাবে পানির মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ হলে ওই পানির মাছ খেয়ে বা পানিতে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের মাধ্যমে মানবদেহে আলসার, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক পরিবর্তন, ব্রঙ্কাইটিস, চর্মরোগ, বধিরতা, দৃষ্টি ব্যর্থতা, লিভার সমস্যা এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিক পাত্রের মধ্য জমা হওয়া পানিতে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকামাকড় বংশবিস্তার করতে পারে। প্লাস্টিক মার্টির উর্বরতা হ্রাস করে। নালা-নর্দমায় পরিত্যক্ত প্লাস্টিক জমে ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যাহত করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার জনকণ্ঠকে জানান, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশের অনেক ক্ষতি করে। তবে এ বিষয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছে না। একটু সচেতন হলেই প্লাস্টিক বর্জ্যরে ক্ষতি থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। পরিবেশবিদরা কিছুটা সোচ্চার হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সারাবিশ্বেই ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবহার বন্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে। যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্দ তথ্যমতে, প্রাণিজগতের একটি বড় অংশ খাদ্যের জন্য পানিতে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা ( জুপ্লাঙ্কটন) এবং ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণার (ফাইটোপ্লাঙ্কটন) ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্রের পানিতে এক পাউন্ড প্লাঙ্কটনের বিপরীতে ছয় পাউন্ড প্লাস্টিক বিদ্যমান। সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, শৈবাল খেয়ে জীবন ধারণ করে। পানিতে পতিত হওয়া প্লাস্টিক এক পর্যায়ে অসম বাতাস এবং স্রোতের মাধ্যমে ভেঙ্গে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। সমুদ্রের পানিতে থাকা মাছ শৈবালের পাশাপাশি প্লাঙ্কটন সাইজের মাইক্রোপ্লাস্টিকও খেয়ে ফেলে। আর সেই মাছ খাওয়ার ফলে প্লাস্টিক পদার্থ মানবদেহেও প্রবেশ করে ভয়াবহ ক্ষতি করে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে সমুদ্র দূষণ একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়ায় জাপান, জার্মানি এবং ইতালির কয়েকটি রাসায়নিক কোম্পানি বায়োডিগ্রেডেবল বা মাটি ও পানিতে মিশে যাওয়ার উপযোগী প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেছে। সমুদ্রের অণুজীবের এনজাইম বা জৈব রাসায়নিক পদার্থ নতুন ধরনের এই প্লাস্টিক ভেঙ্গে প্রধানত পানি এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডে পরিণত করে। এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশ দূষিত প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস করতে একটি আইনগত বাধ্যতামূলক কাঠামোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করা যাবে না। তবে প্লাস্টিক রিসাইকেল উপযোগী করা গেলে অনেক কম ক্ষতিকারক হবে। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে আর প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকবে না। আর তা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক সময় বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য আমদানি করত। কিন্তু এখন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে প্রায় চার হাজার কোম্পানি বছরে ২৪ লাখ টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ থেকে এখন প্লাস্টিক পণ্য রফতানি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এতে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। যদিও প্লাস্টিকের ক্ষতির সঙ্গে তুলনা করলে এতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তবে রিসাইকেলযোগ্য বা বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করা গেলে সার্বিকভাবে দেশের মঙ্গল হবে । প্লাস্টিক কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি করা হয়। মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনে যা যা ব্যবহার হয় তার অধিকাংশই প্লাস্টিকের তৈরি। এটি সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্ক বিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যে কোন আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। সহজলভ্য হওয়ায় সব দেশেই প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। তবে ব্যবহার বাড়ায় জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো-বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. মাহবুব হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, প্লাস্টিক থেকে বিসফেনলসহ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়। এর প্রভাবে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ হতে পারে। যত্রতত্র ফেলে দেয়া প্লাস্টিক মাটি ও বিভিন্ন জলাশয় হয়ে ও সাগরে পতিত হয়। এর বিষক্রিয়ায় সাগরের মাছসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের শিকার জলাশয়ের মাছ খেলে মানবদেহে বিভিন্ন জটিল রোগ হতে পারে। ক্ষতিকর এই প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না। যদিও কোন কোন দেশ প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেছে। পিভিসি প্লাস্টিক পণ্য যেমন- থালা-বাসন, পেয়ালা, গামলা, বালতি, কোমল পানীয়ের পাত্র, স্ট্র, চামচ চায়ের কাপসহ গৃহসজ্জার সামগ্রী, শিশুদের সুইমিংপুল, টাইলস, খেলনা, পানির পাইপ, ড্রাম ইত্যাদি দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এখন বাজারে মসলা, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, চাল, ডাল, চিনি, ফল, আটাসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখা হয় প্লাস্টিকের মোড়কে। আবার বাসায় ফ্রিজে রাখার সময়ও এভাবেই রাখা হয়। টুথব্রাশ, টুথপেস্ট থেকে শুরু করে মোবাইল, পড়ার টেবিল, জিনিসপত্র রাখার কেস, এমনকি আমাদের লেখার জন্য ব্যবহৃত কলমও প্লাস্টিকের তৈরি। আর প্লাস্টিকের বোতলে বিক্রি হয় পানি, তেল, সস, জুস ও ওষুধসহ অনেক কিছুই। দেশে প্রতি মিনিটে তরল পদার্থের সঙ্গে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল ক্রয়-বিক্রয় হয়। এ ছাড়া বছরে ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার হয়। যা ব্যবহারের পর দূষিত বর্জ্যে পরিণত হয়। এ ছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে খাদ্যচক্রে প্রবেশের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানবদেহের ক্ষতি সাধন করে। আর প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ালে অদৃশ্য মাইক্রো কণা ভয়ঙ্কর বায়ুদূষণ ঘটায়। সার্বিকভাবে পরিবেশে কালো ধোঁয়া, সিসাসহ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থযুক্ত অপরিশোধিত বর্জ্য ছড়ায়। মাটিতে মিশে থাকা প্লাস্টিক কৃষিপণ্য উৎপাদন ও গাছপালা বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। মাটি থেকে অক্সিজেন নিতে বাধা প্রদান করায় অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন ও গাছপালার বৃদ্ধি ব্যাহত করে। কখনও কখনও অকালে গাছ মরে যায়। এ ছাড়া প্লাস্টিকের স্তরের কারণে বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে পৌঁছাতে না পারায় ভূপৃষ্ঠে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এ ছাড়া প্লাস্টিকের কারণে বায়ুদূষণে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্লাস্টিক পণ্য ও প্লাস্টিকের বোতলজাত পানি নিষিদ্ধ করা হয়। আরও কটি দেশও ক্ষতিকর প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলসের বুন্ডানন শহরে প্লাস্টিকের বোতলে পানির বিপণন ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্লাস্টিক দূষণের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ এখন দশম স্থানে। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশবিদরা সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন উদ্ভিদের সেলুলোজ ও নাইট্রিক এসিডের মধ্যে বিক্রিয়া করে। তিনি এর নাম দেন পার্কেসিন। এরপর ১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলে কৃত্রিম পলিমার ও সেলুলয়েড আবিষ্কার করেন। ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড সম্পূর্ণ সিনথেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। এছাড়া যে দুজন বিজ্ঞানী প্লাস্টিক উৎপাদনে অনন্য অবদান রাখেন তারা হলেন পলিমার রসায়নের জনক নোবেলজয়ী হারমেন স্টাওডিঙ্গার ও পলিমার পদার্থবিদ্যার জনক হারমেন মার্ক। প্রথমে নাইলন ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনথেটিক থার্মোপ্লাস্টিক পলিমার। পরে এ্যাক্রাইলিক, পলিস্টাইরিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, সিনথেটিক রাবার, পলিইথিলিন (পলিথিন) ইত্যাদি প্লাস্টিক আবিষ্কারের ফলে জীবনের সকল স্তরে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ পণ্য ও এর অংশবিশেষ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে এখন জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের সবকিছু প্লাস্টিক দূষণের শিকার।
×