ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈগল পরিবহনে ট্রাঙ্কের ভেতর মরদেহ, রহস্য উদ্ঘাটন

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ঈগল পরিবহনে ট্রাঙ্কের ভেতর মরদেহ, রহস্য উদ্ঘাটন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছয় বছর আগে রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে ঈগল পরিবহনের একটি বাসে মেলে ট্রাঙ্কভর্তি এক নারীর মরদেহ। পরিচয় না পাওয়ায় মরদেহটি অজ্ঞাতনামা হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দারুস সালাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে ২০১৫ সালের ৩ মে মামলা করেন। পরে লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। মামলাটি হওয়ার পর শুরুতে প্রায় তিন মাস তদন্ত করে থানা পুলিশ। এরপর ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করেও এর রহস্য উন্মোচন হয়নি। মরদেহের পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি। দাখিল করা চূড়ান্ত রিপোর্ট না নিয়ে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেন। আদালতের নির্দেশের পর লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর ক্লুলেস এই হত্যাকান্ডের দুই বছর তদন্ত করে এ ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়। এ ঘটনার মূল আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে শুক্রবার ভোরে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। এরপর গ্রেফতারকৃত স্বপন দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দী দেয়। শনিবার দুপুর ধানমন্ডি পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানান। ডিআইজি বনজ কুমার জানান, ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে এক ব্যক্তি একটি ট্রাঙ্ক বাসে তুলে দেন। এ সময় তিনি হেলপারকে বলেন, সামনের ভাটিয়ারি কাউন্টার থেকে এই টিকেটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী ওই কাউন্টার থেকে যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে গাবতলী এসে পৌঁছায়। এরপর বাসের সব যাত্রী তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যান। পরে হেলপার দেখেন যে, একটি ট্রাঙ্ক মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসচালক- হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখেন এটি খুব ভারি। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুস সালাম থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর মরদেহ দেখতে পান। মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করে পুলিশ। প্রথমে থানা পুলিশ তিন মাস তদন্ত করে। এরপর সিআইডি চার বছর তদন্ত করে কোন মামলার রহস্য উন্মোচন ও পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। তিনি জানান, পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পিবিআইকে মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয়। পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) ইউনিট ইনচার্জ বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য সব ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম শহর ও জেলা এলাকার সব থানায় নিখোঁজ জিডির অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা এক সপ্তাহ ধরে কাছাকাছি প্রায় ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদ্ঘাটন করেন। ২০১৫ সালের ১০ জুন ৫৯৯ নম্বর একটি জিডিতে দেখা যায়, শম্পা বেগম চট্টগ্রাম পাহাড়তলী থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় নিহত শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন। ডিআইজি বনজ কুমার জানান , ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান ও নিহত শম্পা বেগমের বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তিনি জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। এ সময় শম্পা হাসপাতালে মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসার সময় তার মেয়ে শম্পার সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রথমে প্রেম ও পরে বিয়ের জন্য চাপ দিলে রেজাউল বদলি হয়ে চট্টগ্রাম চলে যান। এরপর ভিকটিম শম্পাও কিছুদিন পরে তার এক ফুপুর বাসায় থাকেন। তিনি ফয়ে’স লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে পর্যন্ত একত্রে বসবাস করেন। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিয়ে করেননি। পরে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে রেজাউল করিম শম্পাকে ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁিচয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। মরদেহ গোপন করার উদ্দেশ্যে একটি ট্রাঙ্কে ভরে ঈগল পরিবহনের বাসে তুলে দেন। শম্পার বাবাকে জানান, তাকে খুলনার বাসে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে শম্পা বাড়িতে না পৌঁছালে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় একটি জিডি করেন। পিবিআই প্রধান বনজ কুমার জানান, দীর্ঘ তদন্তের পর শুক্রবার রাতে পিবিআইয়ের একটি চৌকস দল রেজাউল করিম স্বপনকে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। শনিবার রেজাউলকে আদালতে পাঠানো হলে তিনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দেন। ভিকটিমের বাবা পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ আসামি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গোপন তদন্তের ভিত্তিতে জানা যায়, রেজাউলকে তার বাহিনী থেকে ২০১৯ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
×