ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

‘মুজিববাদই’ জাতীয় আদর্শের পাঠ্যক্রম

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

‘মুজিববাদই’ জাতীয় আদর্শের পাঠ্যক্রম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সত্যকবি’ কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণে জাতির আদর্শ নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক ভিত্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘করোনি বরণ দাসত্ব তুমি আত্ম-অসম্মান,/ নোয়ায়নি মাথা চির-জাগ্রত ধ্রুব তব ভগবান,/ সত্য তোমার পর-পদানত হয়নি ক’ কভু, তাই/ বলদর্পীর দন্ড তোমায় স্পর্শিতে পারে নাই!/ যশ-লোভী এই অন্ধ ভন্ড সজ্ঞান ভীরু-দলে/ তুমিই একাকী রণ-দুন্দুভি বাজালে গভীর রোলে!/ মেকীর বাজারে আমরণ তুমি রয়ে গেলে কবি খাঁটি,/ মাটির এ দেহ মাটি হল, তব সত্য হল না মাটি।/ আঘাত না খেলে জাগে না যে-দেশ, ছিলে সে দেশের চালক,/ বাণীর আসরে তুমি একা ছিলে তূর্যবাদক বালক।’ মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাবনা-ধারণা কালান্তরে কতটুকু প্রায়োগিক ও প্রাসঙ্গিক; দুঃসাধ্য-দুরূহ হলেও তার নিরন্তর আলোচনা-পর্যালোচনার কোন চৌহদ্দি সমুদ্ভূত নয়। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু বাঙালীর চিন্তা-চেতনায় চিরঞ্জীব মহীরুহরূপে কালের প্রবাহমান আবর্তে প্রতিটি ক্ষণেই জাগরুক আছেন এবং থাকবেন। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর মহান ত্যাগের আলোকবর্তিকায় বাঙালী জাতি চিরকালই অসত্যকে পরাভূত করে সত্যের বিজয় পতাকা উড্ডীন রাখবেই- দৃঢ়ভাবে তা বলা যায়। প্রাসঙ্গিকতায় বাঙালী জাতির জন্য প্রদর্শিত ও প্রতিস্থাপিত দর্শন আবিষ্কার-অনুসন্ধান-বিশ্লেষণে মুজিববাদ প্রত্যয়টি পরিপূর্ণ অনুধাবন করা না গেলে জাতি আদর্শ বিচ্যুত হয়ে অশুভ-অন্ধকার শক্তির কূট প্ররোচনায় বিভ্রান্ত-বিপদগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক দর্শন চর্চার কেন্দ্রবিন্দু মুজিববাদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত না হলে আগামী প্রজন্ম ইতিহাস বিকৃতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট উপলব্ধিতে যথার্থ জ্ঞানাঙ্কুর পরিত্যাজ্য হবে। মূলত মুজিববাদ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শনের চার স্তম্ভ তথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তাঁর মতে বাংলাদেশের সকল অধিবাসীর পরিচয় বাঙালী ও বাংলাদেশী। বঙ্গবন্ধু বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করতেন। বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষায় গড়ে ওঠা বাঙালী জাতি এবং বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুদৃঢ় বিরোচনে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুজিববাদের মূল লক্ষ্য। বাঙালী জাতিগোষ্ঠীর শিকড় অনুসন্ধান এবং শাশ্বত-সাবলীল কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের আলোকে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় কবি নজরুল, পল্লীকবি জসীম উদ্দীনসহ অনেকেই বাঙালীর স্বাধীন সত্তার ভাবনাকে উন্মীলিত করলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধুই সকল চিন্তা-চেতনার সমাহারে স্বতন্ত্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসেবেই দেশ ও বিশ্বস্বীকৃত। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবিঠাকুরের এই অমিয় সঙ্গীতকে বঙ্গবন্ধু শুধু হৃদয়ঙ্গম করেননি, স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এটিকে বাঙালীর জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রকৃষ্ট প্ররোহ নির্মাণে নিখাঁদ ব্রতী ছিলেন। বাঙালীর আত্মপরিচয়ের উৎসমূলে যেসব গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যিক স্মারক দীর্ঘকালব্যাপী বাঙালী জাতির চেতনায় জাগ্রত ছিল তার অপরূপ আচ্ছাদনই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবং বাস্তবায়ন একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাপ্নিক চেতনায় প্রোজ্জ্বল ছিল সমাজ-গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজের অভ্যুদয়। নতুনধারার সম্মোহনে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। তিনি বিশ্ববাসীকে বাংলার মাটিতে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেখাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘বিদেশ থেকে হাওলাত কইরা আইনা সমাজতন্ত্র হয় না, ওটা যারা করতে গেছেন কেউ সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পারেন নাই।’ ১৯৭২ সালের ১ মে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু মহান মে দিবসকে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জ্বলন্ত প্রতীক উপমায় ভূষিত করেছিলেন। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট করেছেন যে, অতীতের মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অপপ্রয়োগে গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কর্তৃক জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন আর কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। দৃঢ়কণ্ঠে তাঁর উচ্চারণ ছিল; ‘সম্পদের মালিক জনগণ’। কোন শ্রেণী বিশেষের ভোগ-লালসা-লোভ চরিতার্থে সম্পদের অপচয় করতে দেয়া যাবে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার মাধ্যমে দেশের সমুদয় উৎপাদিত প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক, শ্রমিক ও সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সুষম বণ্টনের যথাযোগ্য প্রক্রিয়া চালু করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছিল কিভাবে শত শত বছর নির্দয়-নির্মম শোষণ শাসনে বাঙালী জাতি নিকৃষ্ট উপনিবেশ ও বিদেশীদের বাজার হিসেবে কদর্য লুণ্ঠনের শিকারে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে গভীরভাবে প্রথিত ছিল- অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মৌলিক অনুষঙ্গ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তনই হবে দুঃখী জনগণের অভাবমোচন ও দুর্দশা লাঘবের অন্যতম পন্থা। ধারাবাহিকতায় সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা ও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ, লবণ উৎপাদনে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার, নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথার পরিসমাপ্তি ইত্যাদি ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর প্রাথমিক উদ্যোগ। ব্যাংক-বীমা-পাট-বস্ত্র-চিনি শিল্প-অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বৈদেশিক বাণিজ্যসহ শিল্প কারখানার বিপুল অংশ জাতীয়করণ ছিল সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার সাহসিক পদক্ষেপ। শ্রমজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে পুঁজিপতি প্রভুদের ভোগে সম্পদ উৎপাদন নয়, বরং শ্রমিক, কৃষকসহ দেশের অপামর জনগণের কল্যাণে সমগ্র উৎপাদন-বণ্টন-বিতরণে বৈষম্যহীন প্রথার প্রচলনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। শিল্প উৎপাদনের সুফল সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষী ভাইদের ভাগ্যোন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনায় শোষণ-বঞ্চনা বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রমেয় প্রকাশ ছিল অতিশয় তেজোদীপ্ত। জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল দাবি-দাওয়া পেশের মনোভাব পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সার্থকভাবে কায়েম করা ও সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলা সুচারুরূপে অক্ষুণœ রাখার বিষয়টি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সকলকে সজাগ করেছেন। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অবাধ মতামত প্রকাশ নির্ভর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রপঞ্চটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে, শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ।’ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অসাধারণ। স্বাধীন জাতি হিসেবে অর্থবহ স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা অর্জনে স্বাধীন সুপ্রিমকোর্ট এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সকল ধরনের আইনী প্রক্রিয়াকে দৃশ্যমান ও কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান বা শাসনতন্ত্রকে আদর্শের মৌলিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণযোগ্য করার আহ্বান জানান। দেশের শাসনতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শসমূহকে সমুন্নত রেখে জনগণের সকল গণতান্ত্রিক অধিকারকে শুধু স্বীকৃতি নয়; পরিপূর্ণ উপলব্ধি-অনুধাবনে সামগ্রিক জীবন যাপনে এর প্রভাবকে উন্মুক্ত করার ওপর বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম আগ্রহ ছিল যুগান্তকারী। চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দেশ পরিচালিত হওয়ার মূলমন্ত্রকেই ধারণ করার জন্য জনগণকে বারংবার সচেতন করেছেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার - এই বাংলাদেশের মাটিতে এ-সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।’ দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সংস্পর্শে থাকা ‘মুজিববাদ’ বইয়ের লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস কর্তৃক ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর জিন্নাবাদ, গান্ধীবাদ, নাসেরবাদ, ইহুদিবাদ, মাওবাদ, টিটোবাদ, লেনিনবাদ ও মাকর্সবাদের আলোকে নিজের মতবাদের মূল্যায়ন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে তাঁর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ প্রদান করেন। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের নানাবিধ গতিপ্রবাহের আবরণে সৃজন-মনন-গতিশীলতার অপরূপ ভাস্কর্য শৈলীতে শিল্পিত-পুষ্পিত হয়েছে এই মতবাদ। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি-সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়ার সুবাদে কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে তিনি শোষণের কঠিন অসহায়ত্ব-আর্তনাদকে নিগূঢ়ভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। এ দেশে যুগ যুগ ধরে কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ কিভাবে শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিলেন, প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এর নির্মমতা সত্যের কাঠিন্যে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভীক প্রতিবাদী হওয়ার অমিত সাহস যুগিয়েছে। জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউট, ফড়িয়া-ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদী, সা¤্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদীর দীর্ঘ সময় ধরে চলা শোষণে এ দেশের সোনার-মাটির মানুষ একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাদের মুক্তির আকাক্সক্ষায় বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়েছিলেন অধিকমাত্রায় দিশেহারা। ‘মুজিববাদ’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার কোন কোন সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচারবিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলেছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদশের নিজস্ব পথ ধরে।’ যেকোন অসাধ্য সাধনে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি-ব্রত এমনভাবে ইস্পাতকঠিন পরিশিষ্ট রচনা করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা তাঁরই নির্লোভ-নির্মোহ এবং সত্যবাদিতার নান্দনিক ক্যানভাসে প্রস্ফুটিত। সকল অশুভ আঁতাত-আপোসকামিতাকে নিধন করে বঙ্গবন্ধুর সত্যাগ্রহ দর্শনের উৎসমূলে ছিল গভীর দেশপ্রেম-বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি অফুরন্ত মমত্ববোধ ও ভালবাসা। মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সমাসীন করার মধ্যেই মহান স্রষ্টার আনুকূল্য নিহিত; এটি যথার্থ অর্থে ধার্মিকতা-অসাম্প্রদায়িকতার চিরন্তন পরিশীলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর পরিশুদ্ধ মানস। আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রগণ্য কবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘সংগতি’ কবিতার নিম্নোক্ত চরণসমূহ যেন বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করেই প্রণীত। পঙ্ক্তিসমূহের পবিত্রতম নির্যাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নিবন্ধের ইতি টানছি। ‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/ পোড়ো বাড়িটার ঐ ভাঙ্গা দরজাটা। মেলাবেন।/ পাগল ঝাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।/ আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা,/ মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,-/ বন্যার জল, তবু ঝরে জল,/ প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল-মেলাবেন।/ তোমার আমার নানা সংগ্রাম,/ দেশের দশের সাধনা, সুনাম,/ ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিণাম মেলাবেন।/ জীবন, জীবন-মোহ, ভাষাহারা বুকে স্বপ্নেরে বিদ্রোহ-/ মেলাবেন।, তিনি মেলাবেন।’ লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×