ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডেসটিনি টু ইভ্যালি ডিজিটাল ফাঁদ ৫ আলাদিনের প্রদীপ ও সিরাজগঞ্জ শপের অভিনব প্রতারণা

গ্রামে বসেই দেড় শ’ কোটি টাকা লুট

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

গ্রামে বসেই দেড় শ’ কোটি টাকা লুট

রহিম শেখ ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন। মাত্র ২২ বছর বয়সেই কোম্পানি খুলে চটকদার বিজ্ঞাপনে ক্রেতা জুটিয়ে সাত মাসে হাতিয়ে নিয়েছেন ১০০ কোটি টাকারও বেশি। লক্ষাধিক ক্রেতার অর্ডার নিয়ে এখন আর পণ্য দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বন্ধ করে দিয়েছে অফিসও। দেশব্যাপী প্রতারণার জাল বিছানো কোম্পানির নাম ‘আলাদিনের প্রদীপ’। ঢাকায় কোন অফিস না থাকলেও তাড়াশ উপজেলার নিভৃতপল্লী থেকে জ্বালিয়েছেন ‘আলাদিনের প্রদীপ’। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলি ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামের জুয়েল রানা। জেলা প্রশাসনের লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টে প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জশপ ডটকম। শহরের এম এ মতিন সড়ক ও কাঠেরপুল এলাকায় দুটি অফিস নিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের অফারে শুরু করেন অর্ডারের আগাম অর্থ আদায়। অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়েছে সিরাজগঞ্জশপ ডটকমের মালিক জুয়েল রানা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বনানী থানায় অর্থ আত্মসাতের মামলা করেছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, ই-কমার্স অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আলাদিনের প্রদীপ ডটকমে মাত্র আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগে ছয়জনের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু হলেও কিছুদিন না যেতেই বাদ দেয়া হয় পাঁচজনকে। ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে। ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি (ডিবিসি) নামে একটি গ্রæপের মাধ্যমে ক্রেতা জোগাড় করতেন কোম্পানির সিইও মেহেদী হাসান মুন। চলতি বছরের শুরু থেকেই চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন পণ্যে বিশাল ছাড়ও দেয়া হয়। এর পরই মানুষ হুমড়ি খেয়ে অর্ডার দেয়া শুরু করে। প্রথম কয়েক দফা ছাড়ের বিজ্ঞাপনে প্রায় লাখখানেক ক্রেতা জোগাড় হয়ে যায়। কোম্পানি ছড়িয়ে যায় দেশব্যাপী। মূলত এক টাকায় ডেলিভারি, দেশের প্রথম শিক্ষার্থীভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি নানা চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তিনটি অফারে অর্ডার পড়ে প্রায় দুই লাখ। সবশেষ জুনের একটি বিশেষ অফারে ৬১ হাজারেরও বেশি ক্রেতা আলাদীনের প্রদীপে নানা পণ্য অর্ডার করেন। সর্বশেষ তিনটি অফারে বেশিরভাগই ছিল মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনসহ দামী পণ্য। এর পরই পাল্টে যেতে থাকে আলাদীনের প্রদীপের চরিত্র। ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। এমনকি বন্ধ কল সেন্টারও। যারা বেশি বেশি যোগাযোগের চেষ্টা করেন তাদের ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজ থেকে বøক করে দেয়া হয়। বিশাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করলেও ঢাকায় কোম্পানিটির কোন স্থায়ী অফিস নেই। ঠিকানা হিসেবে কেবল লেখা হতো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। ওয়েবসাইটে অফিসের যে ঠিকানা বলা হয়েছে সেই অফিস বন্ধ পাওয়া গেছে। এর আগে কোম্পানির সিইও মুন দাবি করেছিলেন চারটি অফিস রয়েছে তাদের, সবক’টিই সিরাজগঞ্জে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলাদিনের প্রদীপের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, প্রায় লাখখানেক অর্ডারের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। এর আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি। অর্ডারগুলো নেয়ার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অফিস। কোম্পানির সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মেহেদী হাসান মুন ক্রেতাদের থেকে টাকা নিয়ে অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে অন্য উদ্যেক্তাদের একে একে বাদ দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মুন গত এক-দেড় বছরে চালু করেছেন কয়েকটি কোম্পানি। অর্থ ঢালছেন বিভিন্ন পার্টনারশিপ ব্যবসায়। কিনেছেন জমিও। ড্রিমার্স টেলিকম, মাইন্ডিবিডি আইটি কেয়ার, ভিভো এক্সক্লুসিভ শোরুম, মাল্টিব্র্যান্ড মোবাইল প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। সিরাজগঞ্জে জমি কেনার পাশাপাশি ঢাকায় শুরু করেছেন ট্রেডিং ব্যবসাও। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যেই প্রায় আড়াই হাজারের বেশি অর্ডার রয়েছে আলাদিনের প্রদীপে। এর মধ্যে একজন আমিনুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, একটি বাইক ও একটি মোবাইল ফোন অর্ডার করেছিলাম। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর পর থেকে ফোন ধরছে না আলাদিনের প্রদীপের কেউ। কোন মাধ্যমেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ অনলাইন শপটিতে অর্ডার করা বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। রাজধানীতে কোন অফিস না থাকায় তারা কোনভাবেই কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে আলাদিনের প্রদীপের সিইও মেহেদী হাসান মুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফেসবুকে অভিযোগ ও প্রশ্ন লিখে পাঠালেও উত্তর দেননি তিনি। আলাদিনের প্রদীপের ফেসবুক পেজেও প্রশ্ন পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। এদিকে আলাদিনের প্রদীপের মতোই গ্রাহকদের সঙ্গে একই ধরনের প্রতারণা করেছে সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জুয়েল রানা ২০১৭ সালে এটুআই প্রজেক্টের আওতায় সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন আয়োজিত লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ। ট্রেনিং শেষে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম। এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি ‘ইসেলার বাজার লি:’ নামে আরও একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করে তার বিরুদ্ধে। এরপরেই বেরিয়ে আসে জুয়েল রানা প্রতারণামূলক কর্মকাÐ। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠানটির মালিক জুয়েল রানা প্রতারণামূলকভাবে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে। এই ঘটনায় মামলায় উল্লেখ আছে, স¤প্রতি সিরাজগঞ্জ ডটকমের রিফান্ড রিকোয়েস্ট অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নগদ এর নিকট ধরা পড়ে। এ ছাড়া একই পরিমাণ টাকা একই হিসাব নম্বরে বারবার দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করা হচ্ছিল। অদ্ভুত বিষয় হলো, সফলভাবে পণ্য ডেলিভারি হয়ে গেছে-এমন অর্ডারের বিপরীতেও রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসছিল। এ ছাড়া অর্ডার এ্যামাউন্টের সঙ্গে রিফান্ড এ্যামাউন্টের গরমিল। গভীর রাতে রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসতে থাকে প্রচুর। এ বিষয়টি ধরা পড়ার পর ‘নগদ’ সিরাজগঞ্জ ডটকমের সঙ্গে তাদের সব লেনদেন স্থগিত করে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ই-মানি আকারের ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা প্রতারণামূলকভাবে নিয়ে যায়। এরপর নগদের পক্ষ থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নগদকে একটি চিঠি দেয়া হয়। এরপর থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমের মালিক জুয়েল রানার ফোন বন্ধ।
×