ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

এস এম সোলায়মান স্মারকানুষ্ঠান

প্রকাশিত: ০০:১৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

এস এম সোলায়মান স্মারকানুষ্ঠান

পাঁচ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে অস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দ্য আর্টিস্ট। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে কোন সংলাপ নেই। চলচ্চিত্রের শেষে শেষ সংলাপ, ‘ক্যামেরা, রোলিং, এ্যাকশান।’ আর তাতেই ঘোষিত হয়ে গেল, খাদের গহিন থেকে চ‚ড়ান্ত শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া এক অভিনেতার ঘুরে দাঁড়াবার গৌরব গাথা। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক ‘কোর্ট মার্শাল’ এ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি সিপাহী আকবর। সারা নাটকজুড়ে কোন গান নেই। নাটকের শেষে ফাঁসির দড়ি নামার মুহূর্তে ছোট গান, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি লাগে কত ভাল...।’ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের অপমানের বদলা নেয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আকবর হয়ে উঠলো অনুরাগী দর্শকদের অন্তরাত্মার নয়নমণি। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের অশ্রæসজল নয়নমণি, শ্রদ্বেয় রামেন্দু মজুমদারের দূরদৃষ্টিতে যিনি নাট্য সমুদ্রে হঠাৎ ওঠা ঝড়, তার আয়ুষ্কাল সাত চল্লিশ বছরের সংক্ষিপ্ত যাপিতজীবন। জীবনের শেষ পঁচিশ বছর শিল্পসৃজন। অথচ এতটুকু সময়তেই তিনি পাঁচ পাঁচটি নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা, দুই দুইবার থিয়েটার গ্রæপ অফ ফেডারেশনের নির্বাচিত সেক্রেটারি জেনারেল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহŸায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য, তেরোটি মৌলিক ও আঠারোটি রূপান্তরিত মঞ্চ-পথনাটকের নাট্যকার। আমেরিকার অফ ব্রডওয়েতে প্রথম বাংলা ভাষার মঞ্চস্থ আমিনা সুন্দরী নাটকের নাট্যকার এবং নির্দেশক। অসংখ্য গানের রচয়িতা-সুরকার এবং গায়ক। নাট্য প্রযোজনা নির্মাণের নিমগ্নতা এবং দক্ষতায় দর্শকদের হাসাতে-কাঁদাতে-ক্রোধে-উচ্ছ¡াসে-আক্রোশে ক্ষেপিয়ে তুলতে, আত্মবিস্মৃতিকে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করতে, ঐতিহ্যকে লালন করে আধুনিকতাকে ধারণ করে যিনি মঞ্চমায়ায় গড়ে তুলতেন জীবনের শৈল্পিক বাস্তবতা, সত্যের জন্য যিনি সব ছেড়েছেন কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়ে সত্যকে ছাড়েননি, যিনি নাটককে জীবনে করে নিয়েছিলেন জীবনেরই ধ্রæবতারা, তিনি নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, সংগঠক, গায়ক, সঙ্গীতকার, লিজেন্ড অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের তীক্ষè দৃষ্টিতে অসামান্য প্রতিভাধর, তিনিই এস এম সোলায়মান আমাদের সকল নাট্যনুরাগীর কাছে তিনি গভীর শ্রদ্ধার। সেই শ্রদ্ধাভাজন এস এম সোলায়মানের ২০তম প্রয়াণ ও ৬৮তম জন্মদিবস উপলক্ষে তারই প্রতিষ্ঠিত এবং তার ভাব ও আদর্শকে নিয়ে বহমান নাট্যদল থিয়েটার আর্ট ইউনিট আগামী ২৪ মে সেপ্টেম্বর শুক্রবার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে আয়োজন করেছে ‘এস এম সোলায়মান স্মারকানুষ্ঠান ২০২১’। তথ্যচিত্র প্রদর্শন, স্মারক বক্তৃতা উপস্থানপন এবং আমিনা সুন্দরী নাটক মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়েই হবে এস এম সোলায়মানকে ফিরে দেখা, গভীরে ভাবা এবং নিরপেক্ষ অনুধাবন। অনুধাবনের ক্ষেত্রে তথ্যচিত্র নির্মাতা আবু সুফিয়ান বিপ্লব বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করলেও সে যে বিরক্তিকর দেখান না বরং এস এম সোলায়মানের শিষ্যা হিসাবে আজও অনুগত ও বিশ^স্ত, সেটা তার ধারাবাহিক কৃতকর্মে প্রতিফলিত। ফলে অতীতের কুয়াশা সরিয়ে বর্তমানের বর্ণিল আভায় তিনি যে পরিশ্রমী মানুষটির কঠোর পরিশ্রমকে তথ্যচিত্রের ক্যানভাসে তুলে ধরবেন এ আসা করাই যায়। কতটা কিভাবে আশা করা উচিত নাট্যবিদ ড. রতন সিদ্দিকীর বক্তৃতায়, সেটা খানিকটা কুয়াশা অন্তত যেখানে বক্তৃতার শিরোনাম, ‘এস এম সোলায়মানের নাটক রাজনীতির ক্ষতিয়ান।’ রাজনীতির ক্ষতিয়ান কথাটা ব্রিটিশ উচ্চারণ ‘গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে’ উচ্চারণের মতোন। বোঝার উপায় নেই, আদতে এটি মুষলধারে বৃষ্টি নাকি ঝড়ো কালবৈশাখী। তবু নাট্যবিদ রতন সিদ্দিকী যেহেতু খতিয়ান তুলে ধরবেন সেহেতু সাধারণ অনুরাগী দর্শকও মিলিয়ে নেবে নাট্যবিদ বেকন আর নাট্যকার উইলিয়ান শেক্সপিয়ার রূপ রতন সিদ্দিকী এবং এস এম সোলায়মান পারস্পরিক বিশ্লেষণের রসায়ন অম্ল-মধুর মতো একপেশে নাকি রসাদনে সুসম বণ্টিত। বণ্টনে সমতা-অসমতা কতটা কিভাবে তা প্রধান অতিথি গোলাম কুদ্দুছ, বিশেষ অতিথি ষড়ৈশ্বর্য লাকী ইনামসহ অন্যান্য আমন্ত্রিত আলোচকরা তুলে ধরবেন তারা তাদের প্রাজ্ঞতা দিয়ে। তবে বিগত পনেরো বছরের মতো এবারে যে এস এম সোলায়মান প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে না এটা বড় বেদনার। বাৎসরিক দলভিত্তিক অনুদান, হল ভাড়া মওকুফ, প্রদর্শনী শেষে নগদ অর্থপ্রাপ্তির দাবি সেসব অধিকার না অনুগ্রহ সে তর্কের মীমাংসা না হলেও এটা গর্বের যে, একজন প্রতিশ্রæতশীল তরুণ নাট্যকর্মী এস এম সোলায়মান নামাঙ্কিত পদক গ্রহণ করেছে, সঙ্গে নগদ অবশ্য প্রয়োজনী সম্মানী। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের দলীয় প্রধান অভিনেত্রী রোকেয়া রফিক বেবী নিশ্চই বিশ্বাস করেন, ’৮৮-এর বন্যায় কিংবা ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে এস এম সোলায়মান যদি নাট্যকর্মী নিয়ে স›দ্বীপের মানুষের পাশে সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দাঁড়াতে পারেন, দেহের রক্ত বিক্রি করে যদি প্রযোজনার খরচ মেটাতে পারেন, তবে করোনার এই ক্রান্তিকালে তার প্রবহমান চেতনা কেন থমকে যাবে? যদিও দল বলছে, আগামী বছর দলেন ত্রিশ বছর পূর্তিতে বিগত দুই বছরের প্রণোদনা দেবে। সেটা ভাল কিন্তু মহত্ত¡ না। কারণ বিপদের বন্ধুই বড় বন্ধু। যে বন্ধু সে সর্বদা সুরক্ষা দিতে চাওয়ার বন্ধু। এস এম সোলায়মান যে কত বড় বন্ধু সে তো চাক্ষুস দেখেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমানের মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেও স্বৈরশাসক তার বাহিনী পাঠিয়ে ঘেরাও করলে এস এম সোলায়মানকে দেখেছিলাম পথ থেকে ঢিল ছুড়ে মারতে। এ লড়াই তার আজীবন। এম কোন রাজনৈতিক সঙ্কট নেই যেখানে তিনি নাট্য নির্মাণের মধ্যে দিয়ে শিল্পের লড়াই চালিয়ে যাননি। হয় পথে নয় মঞ্চে।’ মঞ্চে স্মারকানুষ্ঠান শেষ হবে এস এম সোলায়মান রচিত নাটক আমিনা সুন্দরী মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে। নারীর আত্মত্যাগকে উপেক্ষা আর প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসিকতাকে পুড়িয়ে দেয় এস এম সোলায়মানের নাটক আমিনা সুন্দরী। এস এম সোলায়মান না তুষের আগুন না দাবানল, এস এম সোলায়মান যেন সূর্যের আভার ন্যায় সর্বজনীন এবং চিরন্তন।
×