ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকারদের চাকরির সুরক্ষায় করণীয়

প্রকাশিত: ০০:১৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

ব্যাংকারদের চাকরির সুরক্ষায় করণীয়

আনোয়ার চৌধুরী একটি বেসরকারী ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত আছেন। দক্ষ, সৎ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সুপরিচিত। ইদানীং কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর সময় পার করছেন। এক ধরনের চাপা আতঙ্ক গ্রাস করছে ক্রমশ- চাকরি হারানোর ভয়। নিজেকে নিয়ে যতটা না তিনি চিন্তিত তার চেয়েও বেশি মানসিক পীড়ায় আছেন বেশ কয়েকজন প্রিয় সহকর্মীর হঠাৎই চাকরিচ্যুতির কারণে। বিষয়টা কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটছে। শুধু যে তার ব্যাংকেই এমনটা হচ্ছে তা নয়। দেশের প্রতিষ্ঠিত আরও অনেক ব্যাংকের কর্মীরা চাকরি হারাচ্ছেন। বিশেষ করে, গত বছর করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে এরকম দুঃখজনক ঘটনার ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারও কারও বেলায় এমনও হয়েছে, আগের দিন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছেন; পরেরদিন অফিসে এসেছেন, নিজের ডেস্কে গিয়ে সিস্টেমে লগইন করতে গিয়ে দেখেন- ‘একসেস ডিনাইড’। সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, প্রতিষ্ঠানে তার সেবার আর কোন প্রয়োজন নেই। যাকে বলে পত্রপাঠ বিদায়। সঙ্গত কারণেই কর্মীদের মেনে নিতে হয় এরকম মানহানিকর, অমানবিক পরিস্থিতির। স¤প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত এক কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ভুক্তভোগী ওই কর্মকর্তা বিষয়টা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আনেন। নড়েচড়ে বসেন নীতিনির্ধারকরা। এরকম এক প্রেক্ষাপটে ছয়টি বেসরকারী ব্যাংককে বিশেষ পরিদর্শনের আওতায় আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারী ওই ছয় ব্যাংকের ৩ হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন। ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্যমতে, এর মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন ৩ হাজার ৭০ জন; ১২ জনকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ ও ৩০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ছয়টির মধ্যে দুটি স্বনামধন্য ব্যাংকেই ঘটেছে ২,৩০৯টি ঘটনা, যা প্রায় ৭০ শতাংশ। এত অধিক সংখ্যক কর্মকর্তার ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগের বিষয়টিকে স্বাভাবিক মনে করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথাকথিত ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করা কয়েকজন কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে জানান, তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা বলেন, নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে পদত্যাগ করতে বলা হয় তাদের। অনেকসময় উচ্চপদে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পুরোনোদের সরিয়ে তাদের পছন্দমতো লোকজন নিয়োগ দেন। পদত্যাগী কর্মীরা আরও জানান, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে বরখাস্ত করা হয়। ফলে আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় কর্মীরা। অন্য ব্যাংকে যোগদানের সুযোগও থাকে না। তাই সবাই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ছাঁটাই, অপসারণ ও বরখাস্তের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ সমস্ত ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া যেমন- কারণ দর্শানো নোটিস বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া, ইত্যাদি অনুসরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহের কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। একটি বৃহৎ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেন, তার ব্যাংকে পদত্যাগী অধিকাংশ কর্মকর্তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ইচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন। তিনি বলেন, এদের বেশির ভাগ অন্যত্র ভাল সুযোগ পেয়েছেন, কেউবা পারিবারিক কারণে, কেউ আবার বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অথবা উচ্চশিক্ষার্থে চলে গেছেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে প্রকাশিত হয়েছে ভিন্নচিত্র। এরই প্রেক্ষিতে বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে বলা হয়েছেÑ ১. সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোন অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত না করা। ২. করোনাকালীন শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণ প্রদর্শন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য না করা। ৩. ১ এপ্রিল ২০২০ তারিখ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোন অভিযোগ না থাকা সত্তে¡ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধিমোতাবেক চাকরিতে বহাল করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত অসংখ্য কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা বিধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অভ‚তপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। প্রশ্ন বা প্রত্যাশা হলোÑ বাস্তবে এই নির্দেশনা প্রতিপালিত হবে কি? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে দেশের বেসরকারী ব্যাংকসমূহকে সর্ব বিষয়ে কি নজরদারিতে আনা সম্ভব? কোনরকম ব্যত্যয় বা বিরোধ দেখা দিলে সেটার মীমাংসা হবে কিভাবে? মহামারী শেষে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে তখন কি এই নির্দেশনা কার্যকরী থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে কিংবা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানকল্পে বিষয়টার একটু গভীরে যেতে হবে। প্রথমেই আসা যাক কেন এরকম অবস্থার সৃষ্টি হলো? মহামারীর কারণে গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তড়িঘড়ি করে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেন। স্থির খরচ (ফিক্সড কস্ট) কমানোর সবচেয়ে সহজ এবং ত্বরিত উপায় হচ্ছে জনবল কমানো। ফলে খ—গ নেমে আসে কর্মীদের ওপরে। পারফরম্যান্স বা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে চাকরিচ্যুত করা হয় অনেককে। অথচ তৃতীয় প্রান্তিক থেকে দেশে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতে শুরু করে বিশেষ করে তৈরি পোশাক এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স- এই দুই গুরুত্বপূর্ণ খাত ঘুরে দাঁড়ায় অনেকটাই। ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে ওষুধ, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্যপণ্য খাত। এর প্রভাব পড়তে শুরু করে ব্যাংকের ওপরে। ফলে, বছর শেষে দেখা যায় মহামারীর কারণে সৃষ্ট প্রতিক‚ল অবস্থার কারণে অনেক সেক্টর যেখানে অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে পড়েছে, সেখানে তুলনামূলক ব্যাংকিং সেক্টর বেশ ভাল করেছে। ২০২০ সালে অধিকাংশ ব্যাংক সন্তোষজনক মুনাফা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা ছিল ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের তুলনায় মুনাফা কিছুটা কম হলেও ২০১৮ সালের তুলনায় এটি ছিল বেশি। ২০২০ সালের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এই অর্জন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এর সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার মহামারীর ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ব্যাংকে কর্মরত হাজারো কর্মীবাহিনী, যারা অব্যাহত রেখেছিল ব্যাংকিং সেবা এবং প্রকান্তরে অবদান রেখেছিল দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে। উল্লেখ্য, যে ছয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কর্মী ছাঁটাইয়ের অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে তিনটিই ২০২০ সালে ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে! অন্য তিনটি ব্যাংকের মুনাফা ২০১৯ সালের তুলনায় কম হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তারাও সন্তোষজনক মুনাফা করে। স¤প্রতি প্রকাশিত আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই প্রবৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে- কেন তাহলে কর্মীদের এত মূল্য দিতে হলো? ব্যাংকিং সেক্টরে এই মুহূর্তে অন্যতম সঙ্কট হচ্ছে খেলাপী ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপী ঋণের হার মোট ঋণ বিতরণের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যদিও আইএমএফসহ বেসরকারী কিছু প্রতিষ্ঠানের মতে, বাস্তবে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের চেয়ে তিন গুণ বেশি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর অন্যতম কারণÑ ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা বর্তমানে ৬১, যার মধ্যে বেসরকারী ব্যাংক রয়েছে ৪৩টি। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে এই খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। প্রত্যেকেই ব্যবসার জন্য ছুটছেন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্রাহকের পেছনে। এই মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা এবং কর্মীদের ওপরে অত্যধিক লক্ষ্যমাত্রার চাপের কারণে অনেক সময়ই করতে হয় আপোস। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ব্যাংকের সংখ্যা ৩৪, যার মধ্যে বেসরকারী ব্যাংক ২২টি আর বাকি ১২টি সরকারী। এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের দুর্বলতাও এই সমস্যার জন্য দায়ী অনেকাংশে। সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাংকের সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে একীভ‚তকরণ (মার্জার) প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে আসতে হবে। কেননা, তাদের অধিকাংশ আমানতই স্বল্পমেয়াদী। সুশাসন নিশ্চিতকল্পে পরিচালনা পর্ষদ তথা মালিকপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় নজরদারিও এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য একটি নিবেদিতপ্রাণ, অনুপ্রাণিত কর্মীবাহিনীর বিকল্প নেই। কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং একটি সুস্থ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়েই দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এগিয়ে যাবে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে। লেখক : একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত
×