ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের তালিকায় স্বর্ণযুগের রেফারি আনসারুল ইসলাম মিন্টুর নাম না থাকায় হতাশ সাজেদ রহমান, যশোর অফিস

‘ফিরে আসুক ফুটবলের সেই সোনালি দিন’

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

‘ফিরে আসুক ফুটবলের সেই সোনালি দিন’

রেফারি কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু। সোনালী ফুটবল যুগের এক অনন্য নাম। আশির দশকে ফুটবলের বাঁধভাঙ্গা জনপ্রিয়তার সময় মোহামেডান-আবাহনীর হাইভোল্টেজ ম্যাচ সবচেয়ে বেশি পরিচালনা করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অনেক ম্যাচও পরিচালনা করেন যশোরের এই গুণী ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। তারকা রেফারি পাহাড়সম উত্তেজনা ও চাপ জয় করে বারবার আস্থার প্রতীক খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছে। কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু পেশাদার রেফারি হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে যশোরের মাঠের ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই যশোর লীগে নিয়মিতভাবে কালেক্টরেট ও যশোর টাউন ক্লাবের পক্ষে খেলেছেন। ফুটবল খেলতে খেলতেই এক সময় সিদ্ধান্ত নেন রেফারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার। এই আকাক্সক্ষা এক সময় যশোরের ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ বাল্যবন্ধু আতাউল হক মল্লিকের কাছে ব্যক্ত করেন। আতাউল হক মল্লিক ততদিনে যশোর থেকে এসে ঢাকা ফুটবল লীগের খেলা পরিচালনা শুরু করেছেন। ৭৫ সালের কোন এক সময়ে ঢাকাতে বাংলাদেশ রেফারিজ এ্যাসোসিয়েশন নতুন রেফারি তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। আতাউল হক মল্লিকের অনুপ্রেরণায় রেফারি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন আনসারুল ইসলাম মিন্টু। প্রশিক্ষণে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয় গ্রেডের রেফারি হিসেবে স্বীকৃত হন। প্রশিক্ষণ শেষে যশোরে এসে নিয়মিতভাবে স্থানীয় পর্যায়ের ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি দ্বিতীয় গ্রেডের রেফারি হিসেবে স্বীকৃত হন। পরবর্তীতে এক বছর পরেই ১৯৭৮ সালে প্রথম শ্রেণীর রেফারির মর্যাদা লাভ করেন। বলা যায় এরপরই তার রেফারি জীবনের ভাগ্য দরজা খুলে যায়। ওই বছরই তার ডাক পড়ে ঢাকা ফুটবল লীগে খেলা পরিচালনার জন্য। প্রথমে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব এবং ওয়ারির মধ্যকার একটি ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান। প্রথম ম্যাচ পরিচালনা করে সম্মানী হিসেবে তিনি মাত্র ১৫০ টাকা পেয়েছিলেন। এই ম্যাচে যশোরে দুই কৃতী ফুটবলার সাথী ও কালাম খেলেন। এর এক বছর পরেই বড় ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। জনপ্রিয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও ওয়ারি ক্লাবের ম্যাচ পরিচালনার মধ্যে দিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেন তিনি। তবে ১৯৮৪ সালে হঠাৎ করেই তার জীবনে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। ওই বছর অভিজ্ঞ রেফারিদের বাদ দিয়ে তার ওপর আসে মোহামেডান ও আবাহনীর মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব। তৎকালীন মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচ মানেই দেশজুড়ে দারুণ এক উত্তেজনা। গ্যালারিতে বসা রক্ত টগবগ হাজার হাজার দর্শকের চাপ মাথায় নিয়ে রেফারিদের খেলা পরিচালনা করতে হতো। কিন্তু তখন ম্যাচ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে যেন অমরত্ব লাভ করেন মিন্টু। ওই ম্যাচ খেলার মধ্যে দিয়ে ফুটবল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন ফুটবলের কিংবদন্তি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন। এই ম্যাচে বাদল রায়ের গোলে জয়ী হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। উত্তেজনায় ঠাসা এই ম্যাচের কথা স্মরণে এনে কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘আমি তখন যশোরে। হঠাৎ করেই রেফারিজ এ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাকে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলা হলো। পরেরদিন মোহামেডান-আবাহনীর মাঠ কাঁপানো ম্যাচ। আটজন রেফারি রয়েছেন প্যানেলে। কার ওপর কী দায়িত্ব আসছে কারও জানা নেই। খেলা শুরু হওয়ার একটু আগে জানতে পারলাম গুরুদায়িত্বটা আমাকেই দেয়া হয়েছে।’ ১৯৮৩ সালে কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান। সে বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে মোট চারটি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন কলকাতা মোহামেডান এবং চায়নার একটি ক্লাবের মধ্যকার খেলা। ১৯৮৫ সালে তিনি পাকিস্তানে যান কায়েদি আজম ট্রফির ম্যাচ পরিচালনার জন্য। এ টুর্নামেন্টে মোট ৩টি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। ক্যারিয়ারে ১০টির মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন মিন্টু। ১৯৮৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সার্ক ফুটবল টুর্নামেন্টের ৩টি ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন।’ রেফারি জীবনের সোনালী সময়ের কথা স্মরণে এনে আনসারুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘যতদিন মাঠে বাঁশি হাতে দাঁড়িয়েছি ততদিনই নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থেকেছি। দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচ পরিচালনা করতে সচেষ্ট থেকেছি। প্রতিটি সিদ্ধান্তই বিচক্ষণতার সঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করেছি।’ স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মিন্টু বলেন, সে সময় অনেকে মনে করতেন আমি হলাম ‘মোহামেডান ফেভারিট রেফারি’। বিশেষ করে আবাহনীর সমর্থকেরা এমনটিই মনে করতেন। কিন্তু সেই ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে মোহামেডান-রহমতগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মোহামেডান কোনভাবেই গোল পাচ্ছিল না। এক সময় মোহামেডানের খেলোয়াড়রা একেবারে অধৈর্য হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় খেলার শেষপ্রান্তে ইরানী ফুটবলার নালজেগার ফাউল করে। আমি লালকার্ড বের করি, নালজেগার মাঠের বাইরে চলে যায়। লালকার্ড দেখানোর পরে সে কি উত্তেজনা মাঠজুড়ে। শেষ পর্যন্ত ওই ম্যাচে মোহামেডান ড্র করে। মনে আছে সেদিন আবাহনীর সমর্থকের আমার সম্পর্কে ভুল ভাঙ্গে। আশির দশকের দেশের সেরা তারকা ফুটবলারদের কাছ থেকে দেখেছেন আনসারুল ইসলাম মিন্টু। সবার খেলা এখনও তার চোখে ভাসে। কাজী সালাহউদ্দিন, আসলাম, বাদল রায়, সালাম, চুন্নু, বাবুল, জনি, মুন্না, রঞ্জিত, রুমি, মনু-সবার খেলাই তার মুখস্ত। আসলামের গোল করার দক্ষতা এখনও তাকে শিহরিত করে। তিনি বলেন, ওর ব্যক্তিগত স্কিল ততটা উঁচুমানের ছিল না। কিন্তু ডি-বক্সের হিরো আসলাম। গোল কীভাবে করতে হয় ভাল জানত। মুন্না মেজাজি হলেও কোনদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। ফাউল করার পরও বল নিজ হাতে তুলে আনত। কাজী সালাহউদ্দিন, বাদল রায়, চুন্নু, বাবুলের সেই আন্তরিক আচরণ এখনও মনে দাগ কেটে আছে। আনসারুল ইসলাম মিন্টুর বর্তমান বয়স ৭৫। যশোরের ঘোপ এলাকায় নিজের বাড়িতে থাকেন। দুই সন্তানের জনক তিনি। তার দুই ছেলে কাজী ইমরান ওয়াহিদ ও কাজী এরফান ওয়াহিদ। স্ত্রীর নাম সাবিনা ইসলাম। জীবনের শেষ বেলাতেও ফুটবল এখনও তাকে টানে। যশোরে কোন টুর্নামেন্ট হলে এখনও চলে যান মাঠে। যশোরের বেশ কয়েকজন তরুণ রেফারি তারই হাতে তৈরি। দেশের বিবর্ণ ফুটবল দেখে অনেকের মতো তারও মন খারাপ হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে ফুটবলের আমরা সাক্ষী, তার কিছুই এখন নেই। ফুটবলে সেই সোনালী দিন ফিরে আসুক এটিই কাম্য’। গম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য ৮৮ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের নাম ঘোষিত হলেও সেখানে নেই কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টুর নাম। উল্লেখ্য, ফিফা স্বীকৃত এই রেফারি ১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ণাঢ্য রেফারিং জীবনের সমাপ্তি টানেন।
×