ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ প্রদর্শনী ঘিরে কৌত‚হলী চোখ

হস্ত ও কারুশিল্পে রোহিঙ্গা জীবন সমাজ সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

হস্ত ও কারুশিল্পে রোহিঙ্গা জীবন সমাজ সংস্কৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ হস্ত ও কারুশিল্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের জীবন। সমাজ সংস্কৃতি। চিত্রকর্মসহ অন্যান্য মাধ্যমে দুঃসহ অতীত, দোলাচলে থাকা বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সব মিলিয়ে অন্যরকম এক প্রদর্শনী। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটো গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব চর্চা, ঐতিহ্যপ্রেম ও সৃজনশীলতার চমৎকার বহির্প্রকাশ ঘটেছে, যা দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) অব দ্য সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি এ্যান্ড গবর্নেন্স (এসআইপিজি) অব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ)। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের পেছনের ইতিহাসটা একবার স্মরণ করা চাই। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৮ সালে ২ লাখ ৩৩ হাজার এবং ১৯৯১ সালে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তবে সবচেয়ে বড় ঢলটি নামে ২০১৭ সালে। ওই বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় মদদে সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স সংঘটিত হতে থাকে দেশটিতে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৬ লাখ ৯২ হাজার ৯৯৮ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজারের অস্থায়ী ক্যাম্প ও ভাসানচরে বসবাস করা রোহিঙ্গার সংখ্যা কমপক্ষে ১২ লাখ। এই মানুষগুলোর দুর্বিষহ জীবন, কান্না ও বঞ্চনার ইতিহাসই সব সময় সামনে এসেছে। ক্যাম্পগুলো থেকে নিয়মিত বিরতিতে আসে নেতিবাচক সংবাদও। তবে প্রদর্শনীতে রোহিঙ্গাদের যে উপস্থাপনা তা নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া সকলেই সৃজনশীল চর্চার সঙ্গে যুক্ত। কেউ হস্ত ও কারুশিল্পী। কেউ সুচিশিল্পে নিজের ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করছেন। কেউবা চিত্রকর্মে। ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে রোহিঙ্গাদের যাপিত জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। কালচারাল মেমোরি সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত রোহিঙ্গা কারিগররা তৈরি করেছেন অধিকাংশ নিদর্শন। তাদের এ কাজে সহায়তা দিয়েছে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যকে বৃহৎ পরিসরে সংরক্ষণে আরসিএমসির চলমান উদ্যোগের অংশ এ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প নিদর্শন। যে ধরনের ঘরে তারা বাস করতেন, সেই ধরনের ঘরের মডেল তৈরি করা হয়েছে। রাখা হয়েছে আসবাবপত্রও। আলাদা নজর কাড়ে নৌকাগুলো। কাঠের তৈরি নৌকার মডেল কৌত‚হলী চোখে অনেকেই দেখছেন। কারণ এগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নৌকার বেশ অমিল লক্ষ্য করা যায়। রোহিঙ্গাদের তৈরি নৌকার স্বতন্ত্র ফর্ম। ব্যবহারের দিক থেকেও ভিন্নতা রয়েছে বলে জানা যায়। নৌকা তৈরির মাধ্যমে মিয়ানমারে ফেলে আসা নদী ও নৌকাকেন্দ্রিক জীবন জীবিকার কথাই যেন স্মরণ করছেন তারা। একই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে কৃষিকাজ, মৎস্য শিকার এবং গৃহস্থালিকর্মে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। এগুলো দেখে রোহিঙ্গাদের পেশাগত ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি কারুশিল্পে তাদের দক্ষতা কত তা অনুমান করা সম্ভব হয়। আরাকানে (বর্তমান রাখাইন) ফেলে আসা জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়ার আকুতিও প্রবলভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেও রোহিঙ্গা কারিগরদের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শনীতে আরও আছে চিত্রকর্ম। এসব চিত্রকর্মে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনকে তিনটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। নিজেদের দেশ মিয়ানামরে থাকাকালীন তাদের জীবন কেমন ছিল তা দেখানো হয়েছে ‘মিয়ানমার লাইফ’ শিরোনামে। ‘ক্যাম্প লাইফ’-এ বাংলাদেশে স্থাপিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর ছবি। দুঃসহ অতীত বা দোলাচলে থাকা বর্তমান নয় শুধু, ভবিষ্যত স্বপ্নের কথাও তুলে ধরা হয়েছে চিত্রকর্মে। ‘ফিউচার লাইফ’ পর্বে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার, মানবিক অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নের কথা বলছে। প্রদর্শনীটির লক্ষ্য সম্পর্কে আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলছেন, এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেয়া হলো। তাদের ঐতিহ্যের শক্তিকে সামনে আনা হলো। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে। এমন আশা থেকেই প্রদর্শনীর আয়োজন। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো বলেছেন, রোহিঙ্গা কালচালার মেমোরি সেন্টার এবং এ জাতীয় যত প্রয়াস আছে সেসবের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বস্তুগত এবং অধরা ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা। প্রদর্শনীটি রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিশ্চিত করবে এবং মাতৃভূমির সঙ্গে তাদের বন্ধন দৃঢ় করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এ্যানে জেরার্ড ভ্যান লিউয়েন বলেন, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হচ্ছে মনের প্রতিফলন, উজ্জীবন এবং লালন-পালন। শিল্পকর্ম, কারুশিল্প এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ সবার জন্য সুগম করা উচিত। বিশেষ করে বাস্তুহারা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের জন্য। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিচয় সংরক্ষণের মাধ্যমে আরসিএমসি তাদের আশা এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রদর্শনীটির মাধ্যমে আমরা বলতে চাই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে শ্রদ্ধাশীল। তিনি জানান, রবিবার শুরু হওয়া প্রদর্শনী আগামী শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। পরবর্তীতে অনুরূপ প্রদর্শনী আয়োজন করা হবে নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব আমস্টারডামে। অবশ্য কিছু নিদর্শন গবেষণার জন্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েও রাখা হবে বলে জানান তিনি।
×