ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অন্জন কুমার রায়

ধর্ষণ ও নির্বিকার সমাজ

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

ধর্ষণ ও নির্বিকার সমাজ

‘ধর্ষণ’ শব্দটি এখন আর প্রাত্যহিক ঘটনার মতো বেদনাহত করে না। শুনতে শুনতে কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। সমাজকে কুশিক্ষার প্ররোচনা থেকে রেহাই দিতে বিবেকবান মানুষ কতবার জেগে উঠবে। এ শব্দটির সঙ্গে আমজনতার এখন নিত্য ওঠাবসা। খবরের মাঝে প্রত্যহ চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। তাই নতুন করে কাউকে এ ব্যাপারে ভাবায় না। সম্প্রতি হবিগঞ্জের লাখাইয়ে তেমনি একটি ঘটনা ঘটে। লাখাইয়ের ঘটনায় কিঞ্চিৎ নতুনত্ব আছে। স্বামীর সঙ্গে নৌকায় করে হাওড়ে ঘুরতে যাওয়া এক নারীকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত। দুর্বৃত্তরা ওই নারীর স্বামী ও তার এক বন্ধুকে বেঁধে রেখে ঘৃণ্য কাজটুকু করে। ধর্ষণের ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে। হুমকি দিয়ে বলা হয়, বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অন্য কাউকে জানানো হলে এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে। প্রথমে হুমকি ও লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখা হয়। তবে, ঘটনাটি ঘটিয়ে ভিডিও করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শর্ত হিসেবে টাকা না দেয়ার কারণে এহেন পরিণতি! কত সুন্দরভাবে শিকারির জালে আটকে রাখার অভিনব কৌশল। এ রকম প্রতারণার জালে কেউ আটকা পড়লে লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ করতে চায় না বা পারে না। হয়ত এ ঘটনাটিও এমনদিকে মোড় নিয়েছিল। ধর্ষকদের চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় ভিডিও প্রকাশ করে এবং ঘটনার শিকার নারী অসুস্থ হওয়ায় মামলা করতে বাধ্য হয়। আমাদের সমাজে একজন ধর্ষিতা কতটুকু উপায়ন্তর না পেয়ে মামলা করতে পারে তা সমাজ বারবার প্রত্যক্ষ করে। এ ঘটনাটি অন্যান্য ঘৃণ্য অপরাধের মতোই আমাদের মনকে নাড়া দেয়। যারা এ সকল ঘটনা ঘটায় তাদের বিবেকবোধ কাজ করে না। তাদের এ কাজটুকু যে পূর্ব পরিকল্পিত নয় তা সহজেই অনুমেয়। নিমিষের সিদ্ধান্তে ত্বরিত গতিতে বিলক্ষণা কাজটুকু সেরে নেয়। তবে, এ রকম মনোবিকার তাদের আগে থেকেই প্রভাবিত করে। যার ফলে তাদের লালসার শিকার হয় নববধূ! মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা নিজ কর্মে প্রতিফলিত হয়। ইতিবাচক ধারা সমাজের পট পরিবর্তনে সাহায্য করে। নেতিবাচক প্রবর্তনে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রতিটি ধাপে আমাদের চেতনার ভিত্তি সমাজ কিংবা পরিবারেই প্রোথিত হয়। তবে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ যারা করে তারা সমাজে একদিনে তৈরি হয় না। সমাজ তাদের অন্ধকার জগত সম্পর্কে ধারণা রাখে। তবে, পরিবার কিংবা সমাজ তাদের মতো মানুষের ঔদ্ধত্যের সীমানা খুঁজে পায় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করারও সাহস পায় না। যার ফলে তারা এসব কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ আমাদের তরুণ প্রজন্ম দেশের সম্পদ, দেশের কর্ণধার। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে সমাজ বাঁচতে শিখে, মনে সাহস জোগায়। তারাই সাবলীলভাবে রুদ্ধ সমাজটাকে মুক্ত করে জাগিয়ে তুলতে পারে। আবার, তারাই চেতনার অধিকার হরণ করে সমাজকে কলুষিত করে। লাখাইয়ের মতো সকল ঘটনা উগরে দেয় সকল অপরাধ। আশার খবর, ইতোমধ্যে কয়েকজন আসামি ধরা পড়েছে। আশা করি বিচারব্যবস্থায় চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং সমাজে এমন গর্হিত কাজ করার সাহস থেকে অনেকেই পিছিয়ে আসবে। ঘটনাটিকে কোনভাবেই বিরল ঘটনা বলার সুযোগ নেই। আমাদের প্রযুক্তি আমাদের সীমানা দেখিয়ে দেয়। আমরা প্রযুক্তির সুফলের চেয়ে কুফলকে সাদরে গ্রহণ করি। নিষিদ্ধের স্বাদ গ্রহণের আনন্দ প্রবল। তাই তো প্রতিনিয়ত নিষিদ্ধের দিকে হাত বাড়াই। হাতে আছে সুন্দর মুঠোফোন। বালকের বালকোচিত মনোজগত কি আর স্মার্টফোনের মাঝে বন্দী থাকে? সহজেই ক্যামেরাবন্দী করতে পারে সব। মনে হয় চেতনার দীক্ষা এখানেই অসম্পূর্ণ! সম্পদ ও শিক্ষার বৈষম্যে দাঁড়িয়ে থাকা সমাজ যখন লালসার সাধনায় মেতে ওঠে তখন মনোবিকারের এমন মহামারী জন্ম নেয়াই স্বাভাবিক। ফলে সমাজে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে তার পেছনে আরও অনেক ধরনের বিকার থাকে। সেগুলো বহুলাংশে অজানাই থেকে যায়। অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তির প্রতি বয়োসন্ধির আকর্ষণ স্বাভাবিক। তাই অপরাধ জগতে তাদের পদচিহ্ন সমাজকে আরও কলুষিত করে। আমাদের সমাজে সামাজিক নজরদারি নেই বললেই চলে। তাছাড়া পারিবারিকভাবেও এতটা কড়া শাসনের মাঝে তারা বেড়ে ওঠে না। ফলে নাবালক কিংবা কিশোর বয়সে অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে হবিগঞ্জের লাখাইয়ের ঘটনা বিশাল হিমশৈলীর চূড়ামাত্র। প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলেই এই পরিণতি। এমন অপরাধ দমনের পরিবর্তে যারা এমনটি করে তাদের শোধরাতে পারলে তা সমাজে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। নয়ত, সে ধরনের ঘৃণিত অপরাধ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। আমাদের সমাজে ধর্ষিতাকে সাদরে গ্রহণ করতে প্রায় অপারগতা দেখা গেলেও বেশিরভাগ সময় ধর্ষককে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেখা যায়। অথচ ধর্ষিতাকে প্রতিক্ষেত্রে তাদের সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। এই লড়াইয়ে কেউ হেরে যায় আবার কেউ জিতে যায়। তবে হেরে যাবার সম্ভাবনাই প্রকট হয়ে ধরা দেয়। সমাজব্যবস্থায় তাদের ঠাঁই হয় সবার অগোচরে। অনেকটা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো। ফলে নারীর স্বতন্ত্রবোধ জেগে ওঠে না। অন্ধকারের গ্লানিময় স্থানকে অতি আপন করে নিতে হয়। আমাদের দেশে নৈতিক শিক্ষার চর্চা দিন দিন কমে আসছে। সমাজে কাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয় সে জ্ঞানটুকুও যেন অপ্রতুল। নামেমাত্র আমরা নারীদের অর্ধাঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করলেও কার্যত কতটুকু সত্য তাই বিবেচ্য। অথচ তাদেরকে প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। যদি মেয়েদের মাঝে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগিয়ে তোলা যায় তবে সামাজিকভাবে হীনম্মন্যতা জন্মাবে না। যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও প্রকাশ না করার ভীতি কেটে যাবে। বস্তুত নারী আত্মনির্ভর হতে পারলে সুরক্ষিত জীবনযাপন করতে পারবে। একজন নারী ধর্ষিত হওয়া মানেই সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ করে দেয়া। তাই, স্কুল-কলেজের পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজনের মধ্য দিয়ে সকলের মাঝে জন সচেতনতা তৈরি জরুরী। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাও রয়েছে। নারীদের বেলায় আইনী সহায়তা কিভাবে পাওয়া যায় সে বিষয়ে বোধগম্য করতে হবে। লেখক : চাকরিজীবী
×