ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তৎপর

অর্থ সংগ্রহে জঙ্গীরা ডাকাতি ছিনতাইয়ে নেমেছে

প্রকাশিত: ২২:০৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

অর্থ সংগ্রহে জঙ্গীরা ডাকাতি ছিনতাইয়ে নেমেছে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পতনের মুখ থেকে আবার চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। আগের রূপে ফিরে আসার জন্য পুরনো ধারার সদস্যদের নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার চেষ্টা করছে। অর্থসংস্থানের জন্য এই সংগঠনের সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরির মতো অবৈধ কাজকে বেছে নিয়েছে। হলি আর্টিজানের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫শ’ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮শত জেএমবি সদস্য। তারপরও জঙ্গী তৎপরতা থামানো যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবারও রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় এক জঙ্গীর পেট্রোলবোমা নিয়ে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি)-এর একটি গাড়িতে হামলার পর ওই জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে একটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই পুলিশ দেলোয়ার নামের ওই জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর শুক্রবার আদালতে সোপর্দ করে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি গুলশানের থাইল্যান্ড দূতাবাসসংলগ্ন সড়কে একটি মাইক্রোবাসে হামলা চালায়। ওই মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-৫৪২৪) ছিল আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এআইইউবির। গাড়িতে এ সময় এআইইউবির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নজরুল ইসলাম ও জুনিয়র এক্সিকিউটিভ নাজমুল হাসান ছিলেন। সামান্য আহত হলেও তাৎক্ষণিক তারা স্থানীয় পথচারীদের সহায়তায় সেই জঙ্গীকে আটক করেন। পরে গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক নুরুজ্জামান তাকে হেফাজতে নিয়ে তার ব্যাগ তল্লাশি করে। পুলিশ তার ব্যাগ থেকে তাৎক্ষণিক দেড় লিটার তরল পদার্থ, দুটি লোহার তৈরি ছুরি ও জাপানী নাগরিকত্বের একটি কার্ড উদ্ধার করে। খবর পেয়ে জঙ্গী প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসির একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেলোয়ারকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার জানিয়েছে, তার বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানাধীন জামির্ত্তা এলাকায়। তার বাবার নাম শাহাজুদ্দিন। সে দীর্ঘদিন জাপানে ছিল। বছর খানেক আগে সে দেশে ফিরে এসে মানিকগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিল। আটকের পর দেলোয়ারকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতেও অভিযান চালায় পুলিশ। তার বাসা থেকে একাধিক ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ও কিছু নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জানা যায়, এক সময় তারা উজ্জীবিত হয়ে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বিদেশী নাগরিক, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর হামলাসহ নাশকতা চালানোর চেষ্টাও করেছিল। এতে সফলও হয়েছিল তারা। পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও তৎপরতার কারণে জঙ্গীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু গত এক বছর ধরে জঙ্গী গ্রুপগুলো আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এই এক বছরে তারা ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলা চালায়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, পুরনো জঙ্গীরা প্রায় কয়েক বছর ধরে লুট, ছিনতাই ও ডাকাতি মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৭-৮ টি ডাকাতি ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকাও লুট করেছে। এমনকি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত কয়েক জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও জঙ্গীবাদ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের মধ্যে এই গ্রুপের কমপক্ষে শতাধিক জঙ্গী নিয়ে সবাইবার ফোর্স তৈরি করছে তারা। এদের নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ-জামালপুর উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত রয়েছে। করোনাকালেও অনলাইনে তারা সদস্য সংগ্রহ, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে অনলাইনগুলো ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি বান্দরবানে গভীর পাহাড়ী অঞ্চলে জঙ্গী ট্রেনিং করেছে কমপক্ষে শতাধিক তরুণ। সংগঠনকে বিস্তৃত করতে রোহিঙ্গা ক্যাস্পগুলো পরিদর্শন করেছেন নব্য জেএমবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী প্রায় দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ জন তরুণীও জঙ্গীবাদের আর্দশে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এরা প্রশিক্ষিত। সম্প্রতি সিটিটিসি ও র‌্যাবের হাতে প্রায় শতাধিক জঙ্গী গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। কিভাবে জঙ্গী সংগঠনগুলো তাদের সংগঠনিক কার্যাক্রম চাঙ্গা করা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে? কিভাবে তারা আগের রূপে ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি দেশে প্রথম প্রশিক্ষিত জোবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা (১৯) নামে এক তরুণী জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর অনেক কিছু বেরিয়ে আসে। এরপরই র‌্যাবের হাতে ময়মনসিংহে চার জঙ্গী ও রাজধানীর বসিলার জঙ্গী আস্তানা থেকে শীর্ষ জঙ্গী এমদাদুল হককে গ্রেফতার করা হয়। এর পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জনকণ্ঠকে জানান, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি তাদের পুরাতন ধারার সদস্যদের নিয়ে আবার কার্যক্রম চাঙ্গা করা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসিলা জঙ্গী আস্তানা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার গ্রেফতার করা হয়। সে তৎকালীন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও সালাউদ্দিন সালেহীনের ঘনিষ্ঠ ছিল। ছয় শীর্ষ জঙ্গী ফাঁসির পর উজ্জ্বল মাস্টার পালিয়ে ছিল। পরে কয়েক বছর ধরে গোপনে শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইয়ের অনুসারীরা প্রায় একশ’ অনুসারীর তালিকা তৈরি করে তাদের খুঁেজ বের করা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে এই শীর্ষ জঙ্গী জামালপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, উত্তরবঙ্গসহ কয়েক জেলার প্রায় ৫০ জন পুরাতন জঙ্গীকে খুঁজে বের করে। এরপর তাদের নিয়ে পুরাতন ধারার সংগঠনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এদের সংগঠনের অর্থ চালানোর জন্য কেউ অর্থ দেবে না। তাই তার ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি করে টাকা সংগ্রহ করে সংগঠন চালানোর চেষ্টা চালায়। সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংকসহ কয়েকটি ডাকাতির মাধ্যমে তারা বিশাল অঙ্কের টাকা লুট করেছে। এরই সূত্র ধরে গত ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ নগরীর খাগডহর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে চার শীর্ষ জঙ্গীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১৪। র‌্যাবের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, হলি আর্টিজানের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫শ’ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮শত জেএমবি সদস্য। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬শ’র ওপর জঙ্গী গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৪শ’ জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এত জঙ্গী গ্রেফতারের পরও ভয়ঙ্কর জঙ্গী নেতা বরখাস্ত মেজর জিয়াসহ জঙ্গী মাস্টার মাইন্ডদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশে এখন আর বড় কোন হামলা বা নাশকতা ঘটানোর সাংগঠনিক সক্ষমতা জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেই। তবে সম্প্রতি জঙ্গী সদস্যরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এরা ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি করে অর্থ জোগান দিয়ে পুরনো জঙ্গীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নব্য জেএমবিকে পুনর্গঠন করতে ও সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থের জোগানে আনলাইনে এ্যাক্টিভ রয়েছে জঙ্গী সদস্যরা। এর আগে তারা রাজধানীর গুলিস্তান, মালিবাগ ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ কয়েকটি স্থানে বোমা হামলা ও নাশকতার ঘটনাও ঘটিয়েছে। তারা এসব হামলার জন্য অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়ে বোমা তৈরি করা হয়েছিল। অনলাইনে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সংগঠনের কয়েকজন প্রশিক্ষক। অবশ্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ওই সব হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা জঙ্গী সদস্যদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি বোমা তৈরির প্রশিক্ষকদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানায়, এসব হামলা চালিয়ে নব্য জেএমবি তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে চেয়েছিল। এছাড়া তাদের টার্গেট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এভাবেই প্রতিনিয়ত তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এমনকি তারা উচ্চ শিক্ষিত তরুণীদের জঙ্গী আর্দশে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষিত করেছে তুলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বড় হামলার সক্ষমতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা বর্তমানে নব্য জেএমবিসহ অন্যসব জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেই। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জনকণ্ঠকে জানান, রাজধানীর বসিলার জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা দুর্ধর্ষ জঙ্গী জেএমবি শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার অনেক তথ্য দিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের এমদাদুল জানিয়েছে, ২০০৩ সালে জেএমবির সাবেক শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের বায়াত গ্রহণ করে সে। এরপর সে-সহ আরও কয়েকজন জামালপুরের একটি আস্তানায় প্রশিক্ষণ নেয়। তখন জঙ্গী উত্থান ছিল। জঙ্গী তৎপরতায় দ্রুত সে ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক নেতায় পরিণত হয়। তার সঙ্গে তৎকালীন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও সালাউদ্দিন সালেহীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জেএমবির শীর্ষ নেতারা যখন ময়মনসিংহ অঞ্চল সফর করত তাদের মিটিংয়ের ব্যবস্থা কর, বয়ানের আয়োজন সবকিছুই এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার করত। ২০০৩ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল সে। ওই ডাকাতির মামলায় একজন চার্জশীটভুক্ত আসামিও সে। নাশকতা ও জঙ্গী সংক্রান্ত মামলায় ২০০৭ সালে, ২০১২ সালে, ২০১৫ সালে, ২০১৬ সালে, ২০২০ সালে তার নামে মামলা হয়। মামলায় সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে। পরে জামিনে বেরিয়ে আসে। র‌্যাব জানায়, উজ্জ্বল মাস্টার ২০০৭ সালে তার নিকট আত্মীয় রফিক মাস্টার হত্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। নিহত রফিক মাস্টার বিভিন্ন সময়ে জঙ্গী সংগঠনের সংশ্লিষ্ট নেতাদের তথ্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে দিয়েছে বলে তাকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিল উজ্জ্বল মাস্টার। সম্প্রতি বসিলায় জঙ্গী আস্তানাও গড়ে তুলে। গত ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ থেকে তার অনুসারী ৪ জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর তার আস্তানার খোঁজ পায় র‌্যাব। এ সময় বসিলার জঙ্গী আস্তানা থেকে শীর্ষ জঙ্গী উজ্জ্বল মাস্টারের কাছ থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, ৫ রাউন্ড গোলা-বারুদ, নগদ তিন লক্ষাধিক টাকা, রাসায়নিক দ্রব্য, দেশীয় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, উগ্রবাদী লিফলেট জব্দ করা হয়। র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত শীর্ষ জঙ্গী এমদাদুল নিজে প্রত্যক্ষভাবে অপারেশন কার্যক্রম তদারকি করতেন। তাদের আইটি সেক্টরকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগও নেন তিনি। তার সাইবার ফোর্সে ৫০ জন সদস্য রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। করোনাকালে সংগঠনের দাওয়াতের পাশাপাশি সদস্য সংখ্যা বাড়াতে অনলাইনে সক্রিয় হয় তারা। তার কাছে হিযবুত তাহ্রীর কিছু লিফলেট ছিল। তারা নিজেদের প্রকৃত জেএমবি সদস্য হিসেবে দাবি করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তিন দিনের রিমান্ড শেষে জঙ্গী এমদাদুল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ১২ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থেকে নব্য জেএমবির বোমাগুরু জাহিদ হাসান রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকানসহ (২৭) চারজনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। জিজ্ঞাসাবাদের বোমাগুরু ফোরকান সিটিটিসিকে জানানা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বিদেশী নাগরিক, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল তার। সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫টি স্লিপার সেলও (ইদাদ) তৈরি করে ফোরকান। প্রতিটি ইদাদে ২০ জন করে সদস্য জাহিদ হাসানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে অনলাইনের মাধ্যমে। এই অনলাইন সেলে ৫০-৬০ জন জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এমনকি বোমার সরঞ্জাম কিনে বান্দরবানের থানচি পাহাড়ে হিজরত করে জঙ্গী ট্রেনিং করেছে কমপক্ষে শতাধিক তরুণ। গ্রেফতারকৃত নব্য জেএমবি সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায়, তাদের অনেক বন্ধু হিজরতের নামে আফগানিস্তান গেছে। তারা ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছায়। এদের একজনে নাম সিলেটের রাজ্জাক। রাজ্জাক নিখোঁজ হওয়ায় তার ভাই সিলেটে কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেছে। তিনি একা নন, তার সঙ্গে আরও অনেক বাংলাদেশী যুবক আছেন। সেখানে তালেবানের সহযোগী হিসেবে তারা কাজ করছেন বলে পুলিশী তদন্ত সংস্থার সূত্র থেকে জানা গেছে। এ ঘটনার পর পুলিশ কমিশনার মোঃ শফিকুল ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সম্প্রতি ক্ষমতা দখল করা আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের আহ্বানে যারা হিজরত করতে দেশ ছেড়েছেন তাদের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে গোয়েন্দারা। দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধ ॥ উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী প্রায় দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে তরুণদের জঙ্গীবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা জঙ্গী রিক্রুটমেন্টের সঙ্গে জড়িত আছে, তারা এসব আইডি খুলে জঙ্গীবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরকম বেশ কয়েকটি ফেসবুক আইডির সন্ধান পেয়েছে তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি। বিশেষ করে ‘হোয়াইট হাউসের মুফতি’ নামক একটি উগ্রবাদী ফেসবুক আইডিসহ কয়েকটি আইডির মালিককে খুঁজছে তারা। সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী সুমন জনকণ্ঠকে জানান, গত ১০ আগস্ট গ্রেফতারকৃত বোমাগুরু ফোরকানসহ চারজন গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত সাইফুল ইসলাম মারুফ ওরফে বাসিরা (২১) জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। তিনি লক্ষ্মীপুর দারুল উলুম আলিম মাদ্রাসা থেকে ২০১৯ সালে ফাজিল পাস করেন। ২০১৯ সালে বাসিরা ফেসবুকে আবু জোবায়ের নামে একজনের কাছ থেকে নব্য জেএমবির দাওয়াত পান। পরে কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওসামার সঙ্গে সরাসরি দেখা করার জন্য তার বাড়িতে যান বাসিরা। পরে তারা ঢাকা থেকে বোমার সরঞ্জাম কেনেন। এরপর ভিডিও দেখে একটি বোমা বানান তারা। এ বছরের শুরুতে কাউসার, বাসিরা ও রুম্মান বন্দরবানের থানচিতে হিজরত করেন। সিটিটিসি প্রধান এবং পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, আলোচিত ধর্মীয় বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের ওয়াজ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বান্দরবানের পাহাড়ে যান নব্য জেএমবির একাধিক সদস্য। তাদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। এদের মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা রিমান্ডে রয়েছেন। এছাড়া আবু ত্ব-হার বিষয়েও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সক্রিয় সদস্য মোঃ কাওসার আহাম্মেদ ওরফে মিলন (৩০) ও জাহিদ মোস্তফাকে (২০) গ্রেফতার করে এটিইউ। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুইটি এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল, চারটি সিম কার্ড, সাতটি উগ্রপন্থী বইয়ের সফট কপি ও প্রিন্টেড হার্ড কপি জব্দ করেছে। এসব বইয়ের মধ্যে আল বালাগ, তিতুমীর মিডিয়া, সাহম আল হিন্দ মিডিয়া, জসীমউদ্দিন রহমানী ও আনোয়ার আল আওলাকীর বই রয়েছে। এছাড়া ফেসবুক ও মেসেঞ্জার থেকে তাদের সংগঠনের উগ্রবাদী কার্যক্রম ও বই বিক্রি সংক্রান্ত ৩৪ পাতার স্ক্রিনশট জব্দ করা হয়েছে। এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার (মিডিয়া এ্যান্ড এ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, গ্রেফতারকৃত কাওসার আহম্মেদ নয় বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর মতাদর্শ প্রচারকারী বই সংগ্রহ করে বিক্রি ও সরবরাহের কাজে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃত জাহিদ মোস্তফা তাকে এই কাজে দুই বছর ধরে সহযোগিতা করে আসছিল। গ্রেফতারকৃতরা চেচুয়া বাজারে বইয়ের দোকানের আড়ালে একাধিক ফেইক ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে সারাদেশে এবিটি সদস্যদের কাছে উগ্র মতাদর্শের বই বিক্রি করত। এছাড়া সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, জনমনে ত্রাস, ভীতি ও জননিরাপত্তা বিপন্ন করার পরিকল্পনা, গোপনে অনলাইন-অফলাইনে উগ্রবাদ ও জিহাদী বই বিক্রির ও জিহাদে উদ্বুদ্ধকরণ ভিডিও শেয়ারের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম পরিচালনা ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। তিনি বলেন, আগে মাদ্রাসায় বা মসজিদে জঙ্গীরা রিক্রুটমেন্টের চেষ্টা করত। এখন ইন্টারনেট তাদের কাজ সহজ করে দিয়েছে। তাই জঙ্গীদের দমনে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধিসহ তাদের নানামুখী অপারেশনাল কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
×