ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইভ্যালির রাসেল দম্পতির বিস্ময়কর উত্থান

প্রকাশিত: ২২:২২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

ইভ্যালির রাসেল দম্পতির বিস্ময়কর উত্থান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ই-কর্মাসের প্রতারক গুরু হিসেবে খ্যাত ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত এই দম্পতিকে নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানিয়েছে তার বিস্ময়কর উত্থানের অবিশ্বাস্য কাহিনী। তারপরই দুপুর ১টায় র‌্যাব সদর দফতর থেকে রাসেল দম্পতিকে র‌্যাবের সাদা প্রাইভেটকারে করে গুলশান থানায় আনা হয়। সেখান থেকেই পরে নেয়া হয় আদালতে। এদিন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এরপর গুলশান থানায় প্রতারণার অভিযোগে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশার থানার উপ-পরিদর্শক ওয়াহিদুল ইসলাম। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিটন তাদের রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আসামিদের বিরুদ্ধে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন দুপুর ২টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে আসামিদের তোলা হয় আদালতে। এদিনও তার পক্ষে আদালত, শাহবাগ ও ধানম-িতে কতিপয় লোক বিক্ষোভ করেছে। এক পর্যায়ে হাতাহাতির দায়ে একজনকে আটক করে পুলিশ। জানা গেছে, বিস্ময়কর উপায়ে উত্থান ঘটেছে এই প্রতারক দম্পতির। মোহাম্মদ রাসেল ২০০৭ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০১০ সালে এমবিএ শেষ করেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। ২০১১ সালে তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরি শুরু করেন। তিনি প্রায় ৬ বছর ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি ২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রায় এক বছর শিশুদের ব্যবহার্য একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করেন এবং পরে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠান খুলে আগের ব্যবসা বিক্রি করে দেন। ২০১৮ সালে আগের ব্যবসালব্ধ অর্জিত অর্থ দিয়ে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু হয়। কোম্পানিতে তিনি সিইও এবং তার স্ত্রী চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। ভাড়া জায়গায় ধানম-িতে প্রধান কার্যালয় এবং কাস্টমার কেয়ার স্থাপন করা হয়। একইভাবে ভাড়া করা জায়গায় আমিন বাজার ও সাভারে দুটি ওয়্যার হাউস চালু করা হয়। কোম্পানিতে একপর্যায়ে ২০০০ ব্যবস্থাপনা স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল। যা ব্যবসায়িক অবনতিতে বর্তমানে যথাক্রমে স্টাফ ১৩০০ জন এবং অস্থায়ী পদে প্রায় ৫০০ জন কর্মচারীতে এসে নেমেছে। কর্মচারীদের একপর্যায়ে মোট মাসিক বেতন বাবদ দেয়া হতো প্রায় ৫ কোটি টাকা, যা বর্তমানে দেড় কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইভ্যালির দায় ও দেনা ছিল ৪০৩ কোটি টাকা। চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া ১৯০ কোটি টাকা। তবে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ইভ্যালির সিইও মোঃ রাসেল জানিয়েছেন, তার দেনা এখন হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি এ কোম্পানিটি কোন ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। প্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করায় দেনা বরাবর বেড়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানান, ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক এ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে গ্রাহকের ৩০-৩৫ কোটি টাকা আটক হয়ে আছে, ওই অর্থ কোম্পানির নয়। র‌্যাব জানিয়েছে, পরের টাকায় বিলাসী জীবনের স্বাদ নিয়েছেন এই দম্পতি। গত জুন থেকে ইভ্যালির কর্মচারীদের অনেকের বেতন বকেয়া থাকলেও মোঃ রাসেল ও শামীমা নাসরিন মাসিক ৫ লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন। এছাড়া তারা কোম্পানির অর্থে দুটি দামী গাড়ি (রেঞ্জ রোভার ও অডি) ব্যবহার করেন। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে। আর ব্যক্তি পর্যায়ে রাসেলের সাভারে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গাসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। ইভ্যালি ছাড়াও রাসেলের আরও কয়েকটি প্লাটফর্ম রয়েছে সেগুলো হলো- ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি। ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল যৎসামান্য নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়া। তারপরও প্রতারণার আরও কিছু কৌশল বের করার জন্য চেষ্টায় ছিল এই দম্পতি। কিন্তু তার আগে ধরা খান তিনি। গত বুধবার রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অভিযোগকারী আরিফ বাকের ও তার বন্ধুরা চলতি বছরের মে ও জুন মাসে কিছু পণ্য অর্ডার করেন। পণ্যের অর্ডার বাবদ বিকাশ, নগদ ও সিটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে পুরোপুরি অর্থ পরিশোধ করা হয়। পণ্যগুলো ৭ থেকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে ডেলিভারি ও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সরবরাহে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠান সমপরিমাণ টাকা ফেরত দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে পণ্যগুলো ডেলিভারি না পাওয়ায় বহুবার ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে ফোন করা হয়। সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর যোগাযোগের মাধ্যমে অর্ডার করা পণ্যগুলো পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারা। এতে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে ইভ্যালি পণ্য প্রদান ও টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির ধানম-ির অফিসে যান। এ সময় এমডি রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এক পর্যায়ে অফিসের ভেতরে অবস্থান করা রাসেল উত্তেজিত হয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন এবং পণ্য অথবা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ভয়-ভীতি ও হুমকিসহ তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়। এতে তারা চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিনযাপন করছেন এবং পণ্য বুঝে না পাওয়ায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মামলার এজাহারে রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি দ-বিধির ধারাগুলো হচ্ছে- ৪২০, ৫০৬ ও ৪০৬। র‌্যাব জানায়, অনেক দিন ধরেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক সভায় ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত কমিটি। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গত ২৫ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডির সব ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে এক চিঠিতে গত মাসে ওই দম্পতির সব ব্যাংক এ্যাকাউন্টের হিসাব চেয়েছিল বিএফআইইউ)। চিঠিতে তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছিল। তারও আগে গত বছরের আগস্টে বিএফআইইউ নাসরিন ও রাসেলের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছিল। সব টাকা বিদেশে পাচারের পরিকল্পনা ছিল ॥ শুক্রবার বেলা এগারোটায় র‌্যাব সদর দফতরে বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যমকর্মীর মুখোমুখি হয় র‌্যাব। এ সময় র‌্যাবের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, তথ্য প্রযুক্তিকে প্রতারণর কাজে ব্যবহার করার জন্য বিশেষ স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন মোহাম্মদ রাসেল। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা, তিনিই চেয়ারম্যান তিনিই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। স্বল্প সময়েই তিনি শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর কোন প্রতিষ্ঠিত বিদেশী কোম্পানির কাছে ইভ্যালি বিক্রি করে লভ্যাংশ নিতে চেয়েছিলেন তিনি। এ পরিকল্পনা মাফিক বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেন এমডি রাসেল। খন্দকার আল মঈন বলেন, একটি বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফার (১ঃ২)-এর আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন মোহাম্মদ রাসেল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপানোও ছিল পরিকল্পনার অংশ। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন রাসেল। দায় মেটাতে বিভিন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদনও একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করেছিলেন। খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা। তাদের চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। নানা সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে রাসেল দম্পতি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটির আরও দায় দেনা রয়েছে জানিয়ে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, দায়ের সর্বমোট পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকার বেশি। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি, কোন ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হতো। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রাসেল আরও জানান, ইভ্যালি ছাডাও তার আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে। এর মধ্যে ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি দিয়েই ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়। তিনি বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন, যাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি করা যায়। ইভ্যালির প্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখেরও বেশি। তিনি বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এত সংখ্যক গ্রাহক সৃষ্টি করেছেন। ইভ্যালির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো হলো- সাইক্লোন অফার বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রি, ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০ শতাংশ ক্যাশব্যাক অফার) প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার; যেমন- বৈশাখী কিংবা ঈদ অফার ইত্যাদি। বিক্রি বাড়ায় গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদাও বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ি, গৃহস্থালি, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারি, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার পণ্যগুলো বেছে নেয়া হয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় রাসেল দম্পতি। এসব পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আকারে দায় তৈরি হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইভ্যালির ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল, নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে পুরোনো গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ দায় ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাসেল। তিনি রাসেল ও তার স্ত্রীর ইভ্যালি প্রতিষ্ঠান চলত পরিবার নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্রে। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়েছেন তারা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ছিল। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়। মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ ॥ এদিকে বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেফতারের সময় থেকেই ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী এই দম্পতির মুক্তির দাবিতে জড়ো হয়। তারাই আবার শুক্রবার ওই দম্পতির মুক্তি দাবি করেন। বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে এ বিক্ষোভ করেন তারা। এদিন দুপুর ২টার দিকে ইভ্যালির সিইও রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে আদালতে আনা হয়। পরে বিকেল ৩টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে আদালত রাসেল ও তার স্ত্রীর তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ খবর শোনার পর ৪০-৫০ জন গ্রাহক আদালতের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা ইভ্যালির সিইও রাসেল ও তার স্ত্রী নাসরিনের মুক্তি দাবি করেন। তাদের দাবি- রাসেলকে গ্রেফতার না করা হলে তারা দ্রুত পণ্য অথবা টাকা ফেরত পেতেন। তবে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়ায় তাদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এজন্য তারা বিক্ষোভ করছেন। পরে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় একজনকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক মোঃ নাজমুল হোসেন। তিনি জানান, বিক্ষোভকারীদের আদালতের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় একজনকে থানায় নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে। আগের দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রাসেল ও শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতারের মুহূর্তে সেই খবর ভাইরাল হয়- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখে ইভ্যালি সিইও’র বাসার সামনে জড়ো হন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন গ্রেফতারের বিপক্ষে। এ সময় গ্রাহকরা রাসেল ও তার স্ত্রীর মুক্তির দাবিতে নানা ধরনের সেøাগান দেন। অফিস ফাঁকা ॥ এদিকে শুক্রবার সকালে ধানম-িতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেটি বন্ধ আছে। সাঁটার খুলে প্রবেশ ও বের হচ্ছেন ভবনটির অন্য বাসিন্দারা। ভবনটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকেই অফিস ছাড়েন ইভ্যালির কর্মীরা। শুক্রবার কেউ অফিসে আসেননি। ইভ্যালির পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেননি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালে ইভ্যালি কার্যালয়ের সামনে কোন গ্রাহককে দেখা যায়নি। এখনও ফেসবুকে সক্রিয় ॥ এদিকে ইভ্যালির কার্যালয় বন্ধ থাকলেও সচল আছে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ। ইভ্যালির ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়, ঘাটতি মেটাতে বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশের সহযাত্রী হিসেবে ইভ্যালির এই পথযাত্রায় আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। এদেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণে আমরা নিজেদের নিবেদন করেছি পুরোটাই। স্বপ্নপূরণের এই যাত্রায় বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ও ই-কমার্সকে সাধারণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে কিছুটা আর্থিক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আমরা এই ঘাটতি পূরণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই লক্ষ্যে বিনিয়োগ প্রাপ্তির সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। সময় ও সুযোগ পেলে একাগ্রতা ও সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নীতিমালার আলোকে এই ঘাটতি পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের আরও কিছু মাস প্রয়োজন ছিল। আমরা দমে যাইনি। আবার ঘুরে দাঁড়াব। গোপন নথিতে কি আছে ॥ এই দম্পতির বাসা থেকে দুইটি স্মার্ট ফোন ও চারটি গোপনীয় দলিল জব্দ করা হয়েছে শুক্রবকার তাদের থানায় সোপর্দের সময় জব্দ তালিকা ও জব্দ হওয়া জিনিসপত্র পুলিশের কাছে জমা দেয় র‌্যাব। গুলশান থানা সূত্রে জানা যায়, র‌্যাব দুইটি পুরাতন স্যামসাং স্মার্ট ফোন ও চারটি গোপন নথি রাসেলের বাসা থেকে জব্দ করেছে। জব্দ হওয়া মোবাইল ফোনগুলোর একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট-২০ ও অপরটি স্যামসাং গ্যালাক্সি এস-২১। জব্দ হওয়া চার গোপনীয় নথির মধ্যে একটি তিন পাতার সমঝোতা স্মারক। যার মাধ্যমে ইভ্যালি অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা করেছে। অপরটি তিনটি তিন পাতা করে মোট নয় পাতা যাতে লেখা আছে ইভ্যালির শেয়ার সংক্রান্ত গোপনীয় নথিপত্র। তবে এসব নথির মধ্যে কী আছে বা কী ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক তা পুলিশ বা র‌্যাব কেউ জানায়নি। দেউলিয়া ঘোষণার চেষ্টা ॥ এদিকে একটি বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি হয়েছিল। প্রথমত ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। পরে দায়সহ কোন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে লভ্যাংশ নিয়ে নেয়া, কোম্পানির কাছে শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপানোর পরিকল্পনা করা হয়। তিন বছর পূর্ণ হলেই শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনাও নেয়া হয়। সর্বশেষ দায় মেটাতে তারা দেউলিয়া ঘোষণার কৌশল গ্রহণ করে। তার আগেই র‌্যাবের কব্জায়।
×