ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তিতে অন্ধকার ভেদ করে আলোর ঝলকানি

প্রকাশিত: ২২:০১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

বস্তিতে অন্ধকার ভেদ করে আলোর ঝলকানি

শ আ ম হায়দার ॥ শহরে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণকালে চোখে পড়ে এক শ্রেণীর নর-নারীকে। যারা রাস্তায় লোকজন চলাচলের আগেই রাস্তা পরিষ্কার করে। তারা সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত, দোকান পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঝকঝকে তকতকে করে রাখে সাত সকালেই। এটাই তাদের কাজ, পেশা। তাদের বাদ দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ভাবাই যায় না। এই পরিচ্ছন্ন কর্মীরাই হরিজন, মেথর, ধাঙড়, ঝাড়ুদার বিভিন্ন নামে পরিচিত। কাজ করে অতি অল্প বেতনে। তারা বাংলাদেশের মূল ধারার বাইরে। অতি অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য এই দলিত সম্প্রদায়ের এখনও সামাজিক স্বীকৃতি নেই। এই জনগোষ্ঠীর লোকেরা যে জায়গায় বাস করে সেখানে স্যানিটেশনের যাচ্ছেতাই অবস্থা। ঘর বাড়ির চারপাশে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। অবস্থাটা এরকম যে মেথরদের আবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্যানিটেশন কি? পচা ও বাসি খাবার খেতে তারা অভ্যস্ত। তাদের জীবনপ্রবাহ এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। পশ্চিম রেলের বৃহত্তম ৪ লাইনে জংশন স্টেশন সংলগ্ন রেল সুইপার কলোনিতে অধিকসংখ্যক মেথর বা সুইপার বাস করে। এখানে এসে তাদের জীবন যাপনের বাস্তব চিত্র চোখে পড়ে। কলোনিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কারুকাজ করা একটি মাঝারি গোছের মন্দির। বাসিন্দরা জানায়, এটি তাদের উপাসনালয়। এখানে তারা হিন্দু ধর্মমতে দুর্গাপূজা কালীপূজাসহ অনান্য দেবতার পূজা করে। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে তারা দাবি করে। আদি পোশাক ছেড়ে এখন বাঙালীদের মতোই পোশাক পরিধান করে। স্থানীয় বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। তবে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে উর্দু হিন্দি মিশ্রিত ভাষায়। তাদের নিয়ে আরও ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ রেল কোয়ার্টারে দুই শ’র মতো পরিবারের বাস। তার মধ্যে রাজকুমার বাঁশফোর (৪৫), রংলাল বাঁশফোর (৪০) আরও দু পরিবারের অবস্থা মোটামুটি ভাল। দশজনের মতো সুইপার জংশন স্টেশনে সুইপার পদে চাকরি করে। বাকিরা একেবারেই কর্মহীন, বেকার তারা গ্রামাঞ্চলে মলভর্তি ট্যাংকি পরিষ্কার, আবর্জনা অপসারণসহ নানা কাজ করে জীবন বাঁচায়। কলোনির স্যানিটেশনের বাজে অবস্থা। পুঁতি দুর্গন্ধময় পরিবেশের কারণে সেখানে একদন্ড অবস্থান করাই মুশকিল। যারা শহর বন্দর লোকালয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে মানুষের জীবন যাপন বাসযোগ্য করেছে, তারাই রয়েছে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। তবে এমন প্রতিকূল অবস্থাতেও এই সুইপার কলোনির শিশু সন্তানরা লেখাপড়ায় যে এতদূর অগ্রসর হয়েছে তা দেখে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। এ যেন অন্ধকার ভেদ করে আলোর ঝলকানি। বৃষ্টিরানী বাঁশফোর পার্বতীপুর আদর্শ ডিগ্রী কলেজের ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ওর বড় বোন বিজলীরানী বাঁশফোর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা পাস করে বিএসসি করছে। ওর বাবা বাহাদুর বাঁশফোর লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ক্লিনার পদে চাকরি করে। রংলালের ১ ছেলে ৪ মেয়ে সবাই লেখাপড়া করে। বড়মেয়ে ডলি এসএসসি পাস করেছে। তার ছোট অঞ্জলী পার্বতীপুর বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে। হিরালাল বাঁশফোরের মেয়ে মিনতি বাঁশফোর দশম শ্রেণীতে পড়ে, অষ্টম শ্রেণীতে মেধা তালিকায় বৃত্তি পেয়েছে। ছোট মেয়ে মামনি পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। পার্বতীপুর টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজে পলট্টিতে আইএ পাস করেছে অমরকুমার বাঁশফোর। এই প্রতিষ্ঠানে অপু পল্ট্রি ট্রেডের দশম শ্রেণীর ছাত্র। অজয় পাঁচবিবি কলেজে ও আলাল (২০) জয়পুরহাট কলেজে লেখাপড়া করে। কমবেশী প্রতিটি পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্কুল, কলেজমুখী। ছেলেরা বিশেষ করে মেয়েদের চালচলন, কথাবার্তা ও বেশভূষা পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বোঝায় যায় না এরা মেথর পরিবারের সন্তান। জানা গেছে, এই পরিবর্তনের নেপথ্যে কাজ করেছে গ্রাম বিকাশ নামক একটি এনজিও। চোখে পড়ল বিকেল বেলা হাল্কা বৃষ্টিতে মেথরদের একদল শিশু রেল কলোনির ফাঁকা জায়গায় ফুটবল খেলছে। তবে স্থানীয় বাঙালী পরিবারের ছেলেরা ওদের সঙ্গে নেই। ওরা অস্পৃশ্য, ছোট জাত এ কারণেই। লেখাপড়া শিখলেও এ কারণে প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। দেখে বাঁকা চোখে। এসব কারণে বৃষ্টি বাঁশফোর দুঃখের সঙ্গে জানায়, জন্মটাই যেন আমাদের আজন্ম পাপ। তবে আমি বিশ্বাস করি এই গোত্রের মেথরের ছেলে সন্তানরাই একদিন উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বৈষম্য ভেদের এই সমাজকে লজ্জা দেবে। দিনাজপুর ছাড়াও ঢাকা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় হরিজন বস্তি আছে। জীবন যাপন ও স্যানিটেশনের তেমন তফাত নেই। এখনও মিশতে পারেনি মূল স্রোতধারার সঙ্গে। তবে সরকারী সুযোগ সুবিধার কারণে তাদের ছেলে সন্তানরা কম পরিমাণে হলেও শিক্ষা-দীক্ষার লাইনে ধাবিত হচ্ছে। তবে বাঙালী সমাজ এখনও তাদের গ্রহণ করতে পারেনি। এখনও শহরে হোটেলে গেলে আলাদা গ্লাসে পানি খেতে হয়। গ্রামাঞ্চলে কোন বাড়িতে গেলে কলার পাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাটির বিষবৃক্ষ রোপণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আর্যরা। তারপর বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত সেই জাতপাতের বিভাজন করেই গেছেন। এই বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনের রূপ নিয়েছিল যে, নিম্নবর্ণের মানুষদের তখন টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। দেবদাসী প্রথা এখনও দক্ষিণ ভারতে টিকে আছে। আর এসব দেবদাসীরা অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায় থেকে আসা। ব্রাহ্মণরা তাদের দিনের পর দিন ভোগ করে, তাতে তাদের জাত যায় না, জাত যায় হরিজনদের হাতের জল পান ও অন্ন গ্রহণ করলে। ধাঙড়রা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও উঁচু বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে মন্দিরে বসে উপাসনার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী দলিতদের মেথর, সুইপার না বলে হরিজন বলার অমোঘ বাণী দিয়ে গেছেন। সাধক লালন ফকির জাত গেল জাত বলে গীতিতে ও বিদ্রোহী কবি নজরুল জাতের নামে বজ্জাতি কবিতায় এই বৈষম্য ও জাতিভেদের কথাই তো উচ্চারণ করেছেন। তারপরও এ সমাজ কি তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে? না দেয়নি। জাতিভেদের এই সঙ্কট এখনও বিদায় নেয়নি ভারত ও বাংলাদেশ থেকে। বিজ্ঞজনেরা এ ব্যাপারে বলেছেন, এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অবদানকে অস্বীকার করা হবে। তাই তাদের সমাজের মূলধারায় সংযোজিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরী। তা না হলে তারা শিক্ষিত হলেও এখনও যে অচ্ছুৎ হয়ে রয়েছে, সেই অচ্ছুৎই রয়ে যাবে । ঢাকায় পেশাজীবী হিসেবে মেথর বা ধাঙড়দের আবির্ভাব হয় ১৬২৪-২৬ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময় মগ দস্যুরা ঢাকায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকা শহর পরিণত হয় লাশের শহরে। এ সমস্ত লাশ সরানোর জন্য মেথর নিয়োগ করা হয়। ১৮৩০ সালে ঢাকা কমিটি ও ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভা গঠনের পর বেতনভোগী শ্রমিক ও দিনমজুরের ভিত্তিতে ময়লা আবর্জনা অপসারণের কাজ পায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। পৌরসভার দায়িত্ব তখন আরও বেড়ে যায়। সেই সময় শুরু হয় বাড়তি ধাঙড় সংগ্রহ অভিযান। পৌর কর্তৃপক্ষ তখন ভারতের কানপুর, মাদ্রাজ ও নাগপুর থেকে দরিদ্র নারী-পুরুষ আনার ব্যবস্থা করে। পৌরসভা তাদের চাকরিসহ টিকাটুলী, আগা সাদেক রোডসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করে। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের অনান্য শহরেও ধাঙড় ও মেথর নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত ভারত থকে আগত ধাঙড়ের মধ্যে মাদ্রাজি, কানপুরী ও নাগপুরীই প্রধান। এদের জীবনাচরণ ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। মাদ্রাজিদের মুখের ভাষা তেলেগু বা তামিল। আর নাগপুরী ও কানপুরীদের ভাষা হিন্দি বা হিন্দ-উর্দু মিশ্রিত। পুরুষদের আদি পোশাক ধুতি, পাগড়ি ও হাতকাটা আচকান। তবে আজকাল প্যান্ট, শার্ট পরে। মেয়েদের পোশাক শাড়ি ও ব্লাউজ আর অলঙ্কার হিসেবে দুল, গোটা, বিছা, চুরিহাঁসুলি, নাকফুল, হার, কড়া ইত্যাদি। এখন বাঙালী মেয়েদের মতো পোশাক পরিধান করে অনেক। উপার্জনমূল কাজ হিসেবে শূকর পালে। ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-১৮৫০) বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক, জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন, রেললাইন বসানোর মাটি কাটা প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, উড়িষ্যা, কুচবিহার, রাচি, মাদ্রাজ ও আসাম থেকে হিন্দি, উড়িষ্যা, দেশওয়ালী ও তেলেগু ভাষাভাষি মানুষের পূর্ব পুরুষদের আনা হয়েছিল।
×