ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চাশ বছরে অর্জন ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:১১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

পঞ্চাশ বছরে অর্জন ও চ্যালেঞ্জ

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাপূর্বক দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ ৫০ বছরের এই কণ্টকাকীর্ণ কালাতিক্রমে অসংখ্যবার হোঁচট খেলেও দমে যায়নি, থেমে যায়নি বাংলাদেশ। এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে, দুর্বিনীত নানা অর্জনের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার সময় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ছিল বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত এদেশকে মোকাবেলা করতে হয়েছে ৭৪-এর তথাকথিত দুর্ভিক্ষসহ অসংখ্য ভয়াবহ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে ঈর্ষণীয় অর্জন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের নিকট এক কেস স্টাডিতে পরিণত হয়েছে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির এই দেশ- বাংলাদেশ। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বৃটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লীগ টেবিল ২০২১-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমান অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বাধীনতার পরপরই তথা ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এখানকার মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। বর্তমানে তা ২২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপিসহ বেশকিছু অর্থনৈতিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে ইতোমধ্যে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। দ্য ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। এই রিপোর্ট আরও বলছে, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭ বা তারও কম। গত অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ৪০.৫৪ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাবলম্বীতা সুযোগ করে দিয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে। এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে উল্লেখযোগ্য বাজেট বৃদ্ধির সুফল সরাসরি ভোগ করছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সারাদেশে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ২ ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সার্বিক অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করবে। শিক্ষা খাতে দেয়া হচ্ছে ব্যাপক বৃত্তি ও প্রণোদনা। সরকারী হিসাব মতে ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি/উপবৃত্তি প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। নিজস্ব অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের ফলে দেশের নারীরা বর্তমানে অনেকটা স্বাবলম্বী। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে কক্ষপথে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল স্থাপন বাংলাদেশের এক যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক অর্জন। দেশের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা ভোগ করছে। বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩য় এবং মাছ, মাংস, ডিম ও শাক-সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ২য় স্থানে। বিশেষত ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এসবের সুফল ছড়াতে শুরু করেছে সর্বত্র। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ বছরে। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮ জন এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে লাখে ১৬৫ জনে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম বাংলাদেশ। শ্রম আইনের ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যাপকহারে ইতিবাচক সংশোধন। চিকিৎসা খাতেও রয়েছে অভূতপূর্ব অর্জন। ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে ৩০০-এর অধিক ওষুধ কোম্পানি, যা ৯৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি বাজারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। দেশ তার সার্বিক সক্ষমতা অর্জন করায় বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ ২০তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা। অন্যদিকে কঠোর হস্তে দমন করতে সমর্থ হয়েছে উগ্রপন্থী, চরমপন্থী এবং ধর্মীয় মৌলবাদসহ সকল সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে। হেফাজত সংক্রান্ত সাম্প্রতিক কার্যক্রম দমন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উর্ধমুখী এই বাঁকবদলে আবশ্যকীয় অবদান রেখেছে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। এত সব অবিস্মরণীয় সাফল্য আর অর্জনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বনেতারা বাংলাদেশকে আজ ভূষিত করছে তেজি ষাঁড়, উন্নয়নের রোল মডেল, এশিয়ান টাইগার, দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণশক্তি এবং অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশসহ আরও বহুবিধ বিশেষণে। বাংলাদেশ আজ স্থান করে নিয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলএসডি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। সে কারণেই আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্য, গণমানুষের আর্থিক অসচ্ছলতা তথা Pocket Poverty, উর্ধমুখী বৈষম্য, অসমতা ও বেকারত্ব দূরীকরণ, প্রান্তিক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ভয়াবহতা, সর্বোপরি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা দূর করতে হবে। যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাহত হতে পারে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে ঐতিহাসিক বিষয়াবলীতে ঐকমত্য স্থাপন করতে হবে। সেইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার, যা দেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রকে পুঁজিবাদের আখড়ায় পরিণত না করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংশ্লেষ ঘটাতে হবে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী প্রজন্মকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মৌলিক রাজনৈতিক ঐকমত্যের স্বার্থে Inclusive রাষ্ট্র দর্শন ফিরিয়ে আনতে হবে। চলমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন রাজনৈতিক স্থবিরতায় পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে একটি কার্যকরী বিরোধী দল অত্যাবশ্যক। সুশাসন ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশকে আরও সুসংহত করতে হবে। সংবাদমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী ও ক্রিয়াশীল করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নিশ্চিত করতে হবে। অনতিবিলম্বে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান করতে হবে। তরুণদের মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হবে। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র গঠনে আরও প্রত্যয়ী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হতে হবে। উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অর্পিত নয়, বরং অর্জিত নেতৃত্বকে উৎসাহিত করতে হবে। সমাজকর্মের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের গঠন ও বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতৃত্বের জ্ঞান ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। দেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে বিশ্বাস করি, ইতিবাচক সকল ধারাকে অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আপন মহিমায়, দুর্জয়, দুর্গম ও দুর্বার গতিতে। বর্তমান বিশ্বের নিম্ন আয়ের অশান্ত অস্থির দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ, যা অস্বীকার করলে অন্ধ বিরোধিতাই করা হবে। লেখক : এম. ফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×