ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম – হজ ও ওমরাহকালীন মদিনা শরিফ জিয়ারতের আদব

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম – হজ ও ওমরাহকালীন মদিনা শরিফ জিয়ারতের আদব

গত শুক্রবার ওমরাহ পালন সম্পর্কে কিছু জরুরী কথা ও মাসলা-মাসায়িল বলে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম। শেষের দিকে বলেছিলাম ওমরাহ যাত্রী স্ব স্ব বিমানবন্দর থেকেই ইহরাম পরে জেদ্দায় নামবেন। ইহরাম অবস্থায় কিছু বর্জনীয় বিষয়ও রয়েছে। যেমন পুরুষের জন্য সেলাইকৃত কাপড় পরিধান/ সুগন্ধী ব্যবহার করা/ শরীর হতে পশম পরিষ্কার করা/ নখ কাটা ইত্যাদি। ওমরাহর ফরজ দুটি : (১) ইহরাম বাঁধা, (২) পবিত্র কাবা শরিফ তওয়াফ করা। ওমরাহর ওয়াজিব দুটি : (১) সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করা, (২) মাথা মুন্ডন করা বা চুল ছোট করা। জেদ্দা বিমানবন্দরে অন্যদের আগে আগে নামার চেষ্টা করুন। এখানে বেশ লম্বা কাজ রয়েছে। সামনের লোকদের অনুসরণ করুন। সর্বশেষ বাংলাদেশী পতাকা অনুসরণ করে বাংলাদেশী ওয়েটিং স্থলে অপেক্ষা করুন এবং সামনে গাড়িতে করে যাত্রা সম্পর্কে বাংলাদেশ হজ মিশনের পোশাকধারী ভাইদের জিজ্ঞেস করুন। তারা আপনাদের মুয়াল্লিমের গাড়িতে সোপর্দ করবেন। ওই গাড়িতে করে নির্দিষ্ট হোটেলে যেতে হবে। হোটেলে পৌঁছার পর বিশ্রাম করুন। খবরদার, ইহরামের কাপড় খুলবেন না। করোনা দুর্যোগে মুয়াল্লিমের পরামর্শ পেলেই নারী-পুরুষ সবাই মিলে আপনাদের সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ওমরাহ করতে বের হন। হজ পালন হোক কিংবা ওমরাহ একজন অভিজ্ঞ বন্ধু আলেম হলে সফরের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এবং ইবাদতের পূর্ণতায় কোন শঙ্কা থাকে না। ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে মসজিদে হারাম দেখলে মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়ুন। জুতাগুলো জুতার থলে অথবা বুকের থলেতে নিন। বাদশাহ আবদুল আজিজ ১নং গেট দিয়ে প্রবেশ করুন। মনে রাখবেন ভারি কোন থলে নিয়ে গেলে পুলিশ আপনাকে তওয়াফের জন্য ঢুকতে দেবে না। মসজিদে নামলেই দেখবেন আল্লাহর কালো ঘর। আস্তে আস্তে এর পাশের ময়দান বা মাতাফে নামুন। এরপর অন্যদের দেখাদেখি পাশের দেয়ালে সবুজ চিহ্নিত রেখাটি আবিষ্কার করুন। সেখানে পৌঁছে আল্লাহর নাম নিয়ে অন্যদের দেখাদেখি তওয়াফ শুরু করুন। একে একে সাত চক্কর। এ সময় হজ গাইডে লিখিত তওয়াফের দোয়াগুলো পড়তে পারেন অথবা নিত্য যেসব দোয়া আমরা দেশে নামাজ কালামে পড়ি তা পড়তে পারেন। কিংবা নিজ ভাষায় আল্লাহকে গুনাহ মাফের জন্য বলতে পারেন। ওমরাহ করার ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি দিক পবিত্র কাবা শরিফ তওয়াফ করা। আল্লাহর ঘরের দরজা ও মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে নিরাপদ দূরত্বে ২ রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা, আরবী নিয়তের দরকার নেই। যমযমের পানি খুব ঠান্ডা বিধায় অল্পই গ্রহণ করুন। এরপর সায়ী শেষ করে মসজিদে হারামের যেসব জারের মধ্যে সবুজ রঙে ‘নট কোল্ড’ লেখা আছে সেখান থেকে ইচ্ছামতো পান করুন। যমযমের পানি দুনিয়াবাসীর জন্য এক বড় নিয়ামত ও নিরাময়। এরপর সায়ী বা দৌড়ানোর জন্য সাফা পাহাড়ের স্থানে যান। হজের বই থেকে নির্দিষ্ট দোয়া পড়তে পড়তে অথবা মনের আকুতি জানিয়ে মারওয়া পাহাড়ের দিকে যান। এভাবে এক চক্কর। আবার সাফা পাহাড়ে আসুন। দুই চক্কর। এভাবে সাত চক্কর দিন। মাঝখানে সবুজ রেখা বরাবর একটু বেশি দৌড়ানোর চেষ্টা করবেন। সর্বশেষ মারওয়া পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে নিজের জন্য প্রিয়জনদের জন্য দোয়া করুন। মা হাজেরার মতো। ওমরাহর সর্বশেষ ওয়াজিব কাজ মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছোট করে স্বাভাবিক হওয়া। এজন্য হোটেলে আসার সময় একটি সেলুনে প্রবেশ করুন ১০/১২ রিয়াল দিয়ে চুল কাটুন। সঙ্গে মহিলা গেলে বাসায় ইঞ্চি পরিমাণ তার চুল কাটতে হবে। এরপর গোসল সেরে স্বাভাবিক পোশাক পরুন। বিশ্রাম করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন, প্রয়োজনে এদিক-ওদিক বেড়ান। একা সফর করবেন না, বাংলাদেশী অথবা ইন্ডিয়ান ড্রাইভারের গাড়িতে উঠুন। আরবদের গাড়িতে উঠবেন না। তাদের সঙ্গে দরদাম ও ভাষাগত সমস্যা হতে পারে। আরবদের গাড়িতে উঠতে হয় জেদ্দা ও মদিনা সফরের সময়। হারাম শরিফে নিয়মিত নামাজ পড়ুন। কলম-কাগজ সঙ্গে রাখুন। নামাজের কাতারের সামনে ঘড়িতে পাঞ্জেগানা নামাজের টাইম দেয়া থাকে, তা নোট করে আমল করুন। ফাঁকে ফাঁকে নিম্নলিখিত জায়গাগুলো জিয়ারত করুন অথবা মসজিদে আয়শা থেকে ওমরাহ করুন। সম্ভব হলে প্রতিদিন আছর/ মাগরিব নামাজের পর ১ বার করে ৭ চক্করে তওয়াফ করুন। মক্কা শরিফে এটি সবচেয়ে বড় ইবাদত। এক একটি তওয়াফ এক একজন প্রিয়জনের জন্যও করতে পারেন। গোটা সফরে মোবাইল কম ব্যবহার করুন। অপ্রয়োজনীয় আলাপ কমিয়ে ফেলুন, মার্জিত আচরণ করুন। সফরের সময় অধৈর্য, দুর্ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা পরবর্তী সারাজীবন অনুতপ্ত হন। ধৈর্য ধরুন। মনে রাখবেন ধৈর্য মানুষকে পথ দেখায়। মক্কা শরিফ থেকে বিদায়ের দুদিন আগে সামান্য বাজার করুন। মদিনা শরিফ রওয়ানা হওয়ার অন্তত ৮/৯ ঘণ্টা আগে ১ বার তওয়াফের স্থানে নামুন। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে শেষ তওয়াফের ৭ চক্কর দিন। পূর্বের মতো দু’রাকাত নামাজ পড়ুন। দীর্ঘ মোনাজাতে আবার আসার তওফিক দানের জন্য ফরিয়াদ করুন। মক্কা আল হারামের ‘দার আত তাওহীদে’র পাশ থেকে সস্তায় মদিনা শরিফের উদ্দেশে প্রতি মুহূর্তে ভাল বাস ছাড়ে। এসব বাস আপনাকে মদিনা শরিফের খুব কাছে ‘বাব আত তামুর’-এ নামিয়ে দেবে। মদিনা ইসলামের বিকাশভূমি। স্বপ্নীল অপরূপ সুন্দর শহর মদিনা। এটি ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নানার বাড়ি। মিরাজের সময় জিবরাইল (আ.) নবীজীকে একবার এখানে সফর করিয়েছেন। মদিনার মাটি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তৈরি করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.), আবু বকর, ওমর ও উসমানকে (রা.)। এখানে সকাল-বিকেল ফেরেস্তাকুলের সর্দার হযরত জিব্রাইল (আ.) ও মিকাইল (আ.) আসা-যাওয়া করতেন। যার ময়দান জিকির আসকারে গুঞ্জন থাকত, এখনও যার মৃত্তিকারাশি প্রিয় রাসূল (সা.)-এর পবিত্র শরীর মোবারককে বেষ্টন করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা বড়ই সওয়াবের কাজ। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, আমার ওপর তার সাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল (ফাতহুল কাদীর)।’ এ শহরে উপস্থিত হওয়ার পর সকল স্থানে ধীরে ধীরে আদবের সঙ্গে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ সকল স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পা মোবারক পড়েছে। সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যে, বেয়াদবির দায়ে পড়ে জিয়ারতের সওয়াব যেন হারাতে না হয়। পবিত্র মদিনা নগরীতে বাস ঢুকলে আর আপনাদের চোখে মসজিদে নববীর মিনার চোখে পড়লে মহানবীর (সা.) ওপর দরুদে ইবরাহীমী পড়ুন। বাস থেকে নেমে পূর্ব প্রদর্শিত নিয়ম অনুযায়ী প্রথমেই হোটেলে উঠুন। বিশ্রাম করুন। ভাল পোশাক পড়ে মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করতে যান। নামাজ শেষ হলে ২১-২৩ নং গেট হয়ে বাবে আবদুল মজিদ দিয়ে সোজা সামনের দিকে গেলেই সামনেই পড়বে হুজুরের রওজা শরিফ। অন্যদের দেখাদেখি দাঁড়িয়ে জিয়ারত করুন। প্রথমেই সালাম দিন নবীজীকে। তারপর হযরত আবু বকরকে (রা.)। তারপর হযরত ওমরকে (রা.)। এরপর সমস্ত নবী রাসূল, নবীজীর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কেরাম, শুহাদায়ে কেরাম, জান্নাতুল বাকির মেহমানবৃন্দ ও নিজের ময়মুরব্বিদের স্মরণ করতে পারেন। নবী (সা.)-এর দেশে সম্ভব হলে আরও কিছু পুণ্য কাজ ও সফর করতে পারেন। যেমন- প্রতিদিন আসরের সময় বাবুস সালাম হয়ে অন্যদের দেখাদেখি সারিবদ্ধভাবে প্রথমে নবীজীর (সা.) শিয়র বরাবর তাঁকে সালাম দিন। তারপর ক্রমান্বয়ে হযরত আবু বকর ও উমরের শিয়র বরাবর তাদের সালাম দিন। রওজা মোবারক থেকে বের হওয়ার পর বিশাল দেয়াল বেষ্টনীতে রয়েছে জান্নাতুল বাকি বা বরকতময় প্রাচীনতম কবরস্থান। এটি জিয়ারত করুন। সবসময় পশ্চিম দিক হয়ে মোনাজাত করবেন। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকগণ বিরক্ত করলে বিরত থাকুন। নবীজীর (সা.) রওজা মোবারকের পাশে রয়েছে ধূসর বর্ণের গালিচা বেষ্টিত জান্নাতের টুকরা বা রিয়াজুল জান্নাহ। মাগরিবের পর অথবা এশার পর অথবা তাহাজ্জুদের আগেই সেখানে ২ রাকাত নামাজ পড়ার চেষ্টা করবেন। এ পবিত্র স্থান কিয়ামতের পর জান্নাতের অংশ করা হবে। এখানে আমাদের নবীজীর (সা.) সাহাবীরা আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাইতেন। নবীজী (সা.) তাহাজ্জুদ পড়তেন। একদিন সময় করে ভোরে একজন পরিচিত বাঙালী ড্রাইভারকে নিয়ে জিয়ারত করতে পারেন মসজিদে কুবা। এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মসজিদে কুবার নামাজ ওমরাহর সমতুল্য। মসজিদে কিবলাতাইন, এখানেও ২ রাকাত নফল নামাজ পড়তে পারেন। উহুদ যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে শহীদদের উদ্দেশে জিয়ারত করুন। তবে মনে রাখবেন, আপনার সবচেয়ে বড় কাজ মসজিদে নববীতে নামাজ পড়া ও দিনে অন্তত একবার রওজা শরিফ জিয়ারত করা। সেখানে বসে বসে দুনিয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে যিকির তিলাওয়াত ও দরুদে নিমগ্ন থাকা। রওয়ানা হওয়ার ৩/৪ দিন আগে আপনাদের বিমানের তারিখ সিডিউল ঠিক আছে কিনা টেলিফোনে কিংবা নিকটস্থ অফিসে যোগাযোগ রাখতে পারেন। জিনিসপত্র যত কম কিনবেন, আত্মীয়স্বজন থেকে হাদিয়া কম্বল যত কম নিবেন আপনার আসা তত আহসান হবে। মনে রাখবেন, উত্তম বস্তু যমযম, আতর, স্বর্ণ, তাসবিহ, টুপি, ওড়না। মাঝখানে বিমান বিলম্বিত বা যাত্রাবিরতি করলে এটিকে ওমরাহর অংশ মনে করুন। ধৈর্য, ইবাদতের সঙ্গে সবাই একত্রিত হয়ে সময় কাটান এবং সামনের বিমান যাত্রার কথা খেয়াল রাখুন। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×