ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

আলোকের ঝর্ণাধারায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

আলোকের ঝর্ণাধারায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক-এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সাহসী এবং গতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের এ রূপান্তরের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় আপন মহিমায় স্থান করে নেয়া একজন বিচক্ষণ সফল রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবের। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই উন্নয়নের সকল ধাপ অতিক্রম করে বাংলাদেশ খুব দ্রুত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে শামিল হবে এক কাতারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গত দুই মেয়াদে বিদ্যুত খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। সারাদেশে শতভাগ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত নিশ্চিতে বিদ্যুত খাতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তা আজ বাস্তব। দেশে এখন ৯৯.৫০% মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে, যা অকল্পনীয়। সবই সম্ভব হয়েছে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী গণমানুষের নেত্রী জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের কল্যাণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বিদ্যুত পায় ছিটমহলবাসী। এতে ছিটমহলের ৩০৮ কিলোমিটার বিদ্যুত লাইন নির্মাণের ফলে ১১ হাজার ৮৮২টি পরিবার বিদ্যুত পেয়েছে। সম্প্রতি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপও বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায়। অথচ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে সংযোজিত হয়। এমনকি ২০০৯ সালের আগে দেশে উৎপাদন হতো সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত। যদিও গ্রীষ্মকালে সে সময় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল মাত্র ৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য বেশি হওয়ায় তখন সারা দেশে ব্যাপক পরিমাণ লোডশেডিং হতো। এতে ব্যাহত হতো শিল্প ও কৃষির উৎপাদন। এর পাশাপাশি ব্যাপক জনদুর্ভোগ তো ছিলই। বিদ্যুত ও জ্বালানি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের কৃষি, শিল্প, সেবাখাতসহ দৈনন্দিন জীবনে তেল, গ্যাস, বিদ্যুত ও জ্বালানি সম্পদের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকের উর্ধগতি নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির জোগান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ৫টি গ্যাসক্ষেত্র ব্রিটিশ তেল কোম্পানি ‘শেল অয়েল’-এর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ক্রয় করার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশজ জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতির সূচনা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেয়ার পর থেকে তুলনামূলক সাশ্রয়ী জ্বালানির উৎপাদক হিসেবে গ্যাসক্ষেত্রগুলো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতি অনুসরণ করে বর্তমান সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নতুন নতুন জ্বালানির উৎস উদ্ভাবন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশসমূহের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুত উৎপাদন ব্যবস্থা জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উনয়নে মূল চালিকাশক্তি। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২৫,২৩৫ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ)। এর মধ্যে গত ২৭ এপ্রিল, ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ ১৩,৭৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করে, যা বর্তমান চাহিদার থেকে বেশি। এখন বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন আছে ৬ লক্ষ ১৪ হাজার কিলোমিটার, যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। এ ছাড়াও বিদ্যুত সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯৯.৫০%-এর বেশি, অচিরেই যা ১০০% এ উন্নীত হবে। বর্তমানে বিদ্যুত গ্রাহক সংখ্যা আছে ৪ কোটি ৯ লাখ, যা ২০০৯ সালে ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বিদ্যুতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং এর উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টার ফসল শতভাগ বিদ্যুতায়ন। এর সরাসরি সুফল পাচ্ছে দেশবাসী। ফলে শিল্প ও কল-কারখানার উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণে, গ্রাম হয়েছে আলোকিত, সেচে আর কৃষকদের কষ্ট হয় না, নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে এবং বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি বিদ্যুত কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বিদ্যুত কেন্দ্র পাঁচটি হচ্ছে- হবিগঞ্জের বিবিয়ানা-৩ ইউনিট ৪০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্র, চট্টগ্রামের জুলদায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র ইউনিট-২, নারায়ণগঞ্জে মেঘনাঘাট ১০৪ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, বাগেরহাটে মধুমতি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র এবং সিলেটের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্রে উত্তরণ। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুত যারা ব্যবহার করেন তাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। কারণ আমরা যে বিদ্যুত উৎপাদন করছি তার খরচ অনেক বেশি। আমরা গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য সেখানে ব্যাপকহারে ভর্তুকি দিচ্ছি। উৎপাদনের যে খরচ সেটা কিন্তু বিদ্যুত বিল হিসেবে জনগণকে দিতে হয় না। অনেক কম টাকা বিল নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে অনুরোধ করব বিদ্যুত ব্যবহারে সচেতন হন। যখন লাগবে না নিজের হাতেই নিজের ঘরে বিদ্যুতের সুইচগুলো বন্ধ করে রাখবেন। তাতে বিলটাও কম আসবে, টাকাও কম দিতে হবে। বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হবে। এ বিষয় একটু নজর দিতে সবাইকে অনুরোধ করব। অচিরেই দেশে বিদ্যুত চালিত মেট্রোরেল চালু হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে ভবিষ্যতে বিদ্যুত চালিত যানবাহনের ব্যবস্থা সরকার করবে, বিদ্যুত চালিত গাড়ি উৎপাদন হবে দেশে, রেল খাতটাকে ধীরে ধীরে বিদ্যুত চালিত খাতে নিয়ে আসাসহ এ রকম ভবিষ্যতের বহু পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০০৯ সালে কাজ শুরুর পর সরকার সফলভাবেই ২০ হাজার ২৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম ১১৯টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সরকার ২০২১ সাল নাগাদ ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছিল। তবে এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত দেশ। ভবিষ্যত প্রজন্ম এর পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাবে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পালা দেবে এ দেশ। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×