ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে ১৩০ টাকা রোজগেরে থেকে ৪৬০ কোটি টাকার মালিক

প্রকাশিত: ২২:২৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

দিনে ১৩০ টাকা রোজগেরে থেকে ৪৬০ কোটি টাকার মালিক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এই তো সেদিনের কথা। মাত্র ১৩০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু এতে পোষায় না বলে ৮ বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর নিজের ওই পদে আরেকজনকে বসিয়ে দিয়ে শুরু করেন দালালি আর বাটপারি। তাতেই মিলে মওকা। রাতারাতি বিন্দু থেকে সিন্ধু পরিমাণ ধন সম্পদের মালিক বনে যান। কি নেই তার ? রয়েছে একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট, গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠান। যার ন্যূনতম মূল্য দাঁড়ায় ৪৬০ কোটি টাকা। এমন আশ্চর্যজনক কান্ডের হোতা নুরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর তার সম্পদের পাহাড় দেখে তাজ্জব বনে যান র‌্যাবের কর্তারা। প্রশ্ন- কিভাবে সম্ভব মাত্র কয়েক বছরেই এত বিপুল পরিমাণ ধন সম্পদের মালিক হওয়া ? সে প্রশ্নের জবাব কিছুতেই মিলাতে পারছেনা র‌্যাব। তবে সেই রূপকথা গল্পের কথা র‌্যাবই মঙ্গলবার সাংবাদিক ডেকে জানিয়ে দেয়। র‌্যাবের দাবি-টেকনাফ বন্দরে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস ও দালালির কৌশল রপ্ত করেন নুরুল ইসলাম। বন্দরে দালালির বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে অবৈধভাবে অর্জন করেছে সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। এছাড়াও নামে-বেনামে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে ১৯টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। দালালির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া টেকনাফ বন্দরের সাবেক চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার অপারেটর নুরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। মঙ্গলবার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সদর দফতরের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে সোমবার মধ্যরাতে ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মোঃ নুরুল ইসলামকে (৪১) গ্রেফতার করা হয়। নুরুল ইসলাম ভোলা সদরের পশ্চিম কানাইনগরের মোঃ আব্দুল মোতালেবের ছেলে। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের জাল নোট, মিয়ানমারের ৩ লাখ ৮০ হাজার মূল্যমানের মুদ্রা, ৪ হাজার ৪শ’ পিস ইয়াবা এবং নগদ ২ লাখ ১ হাজার ১৬০ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার নুরুল ইসলাম তার অপরাধ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন খন্দকার আল মঈন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি বলেন, সে ২০০১ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক ১৩০ টাকা হারে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নেয়। বন্দরে কর্মরত থাকার সময়ে নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস, দালালি ইত্যাদির কৌশল রপ্ত করে। একইসঙ্গে দালালির বিভিন্ন সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়। পরে নিজেই সেই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আস্থাভাজন একজনকে একই পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে। চাকরি ছেড়ে দিলেও দালালি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রেখে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রকৃতপক্ষে নুরুল টেকনাফ বন্দর কেন্দ্রীক দালাল সিন্ডিকেটের প্রধান। তার সিন্ডিকেটে ১০-১৫ জন সদস্য রয়েছে। যারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে দালালি কার্যক্রমগুলো করে থাকে। এই সিন্ডিকেটটি পণ্য খালাস, পরিবহন সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পথে অবৈধ মালামাল খালাসে সক্রিয় ছিল। সিন্ডিকেটের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কাঠ, শুঁটকি, বরইয়ের আচার, মাছ ইত্যাদির আড়ালে অবৈধ পণ্য নিয়ে আসত। চক্রটির সদস্যরা টেকনাফ বন্দর, ট্রাকস্ট্যান্ড, বন্দর লেবার ও জাহাজের আগমন-বর্হিগমন নিয়ন্ত্রণ করত। গ্রেফতার নুরুলের সঙ্গে চিহ্নিত মাদক কারবারিদের যোগসাজশ ছিল বলেও জানা গেছে। অবৈধ পণ্যের কারবারের জন্য হুন্ডি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় এবং চতুরতার সঙ্গে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েস কারসাজি করত নুরুল ইসলাম। অবৈধ আয়ের উৎসকে ধামাচাপা দিতে এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড এবং এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সে। ধন সম্পদ সম্পর্কে র‌্যাব জানায়, দালালি ও অবৈধ কার্যক্রমে অর্জিত অর্থে ঢাকা শহরে ৬টি বাড়ি ও ১৩টি প্লট কিনেছে। এছাড়াও সাভার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ভোলাসহ বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে ৩৭টি জায়গা, প্লট, বাগানবাড়ি রয়েছে। অবৈধভাবে তার অর্জিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। নামে-বেনামে তার বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ১৯টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট রয়েছে। বর্তমানে নুরুল জাহাজ শিল্প ও ঢাকার নিকটবর্তী বিনোদন পার্কে বিনিয়োগ রয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার আল মঈন বলেন, নুরুল ইসলামের সঙ্গে কারবারিদের ইয়াবা বেচাকেনার তথ্যও আমরা পেয়েছি। তার ঢাকার বাসা থেকে ইয়াবাও জব্দ করা হয়েছে। কক্সবাজার ও টেকনাফ কেন্দ্রীক মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। অপারেটরের পদে থাকার সময় আমদানি-রফতানিকারক দুটি বেনামী প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বিপুল অর্থ হাতিয়েছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম দালালির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া অর্থের ব্যবহার বৈধ করতে গড়ে তোলে ৫টি প্রতিষ্ঠান। সরকার দলীয় কোন পদ-পদবি না থাকলেও সখ্যতার ভিত্তিতে দালালির কাজ করত সে। তবে গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতেই এই প্রথম র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় সে। জাল টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার আল মঈন বলেন, পার্শ¦বর্তী দেশ কেন্দ্রীক বাণিজ্য করার সুবাদে সে দেশের দালালদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। সে দেশের দালালদের মাধ্যমে জাল টাকার লেনদেন করত। তার অন্য সহযোগীদের গ্রেফতার করা হবে কিনা জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, যাদের নাম তদন্তে আসবে তাদেরই ধরা হবে।
×