ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আয়ান আব্রাজ

রূপকথার রানী এমার গল্প

প্রকাশিত: ২১:২৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

রূপকথার রানী এমার গল্প

বয়স মাত্র ১৮। এ বয়সেই বিশ্ব টেনিসের পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন এমা রাদুকানু। রবিবার জিতলেন ইউএস ওপেনের শিরোপা। মৌসুমের শেষ গ্র্যান্ড স্লোম টুর্নামেন্টের ফাইনালে তিনি ৬-৪ এবং ৬-৩ গেমে সরাসরি সেটে পরাজিত করেন কানাডার লেইলা ফার্নান্দেজকে। সেইসঙ্গে ইতিহাসের প্রথম কোয়ালিফায়ার হিসেবে কোন গ্র্যান্ড স্লোম জয়ের অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েন গ্রেট ব্রিটেনের এই প্রতিভাবান খেলোয়াড়। ঠিক যেন রূপকথার মতোই এক গল্প। ‘এ’ লেভেলের ছাত্রী হিসেবে চলতি বছরের যাত্রা শুরু করেছিলেন রাদুকানু। বিশ্ব টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়ে তখন তার অবস্থান ছিল প্রায় তিন শ’র ওপরে। দুদিন আগে সেই তরুণীই বাজিমাত করলেন ইউএস ওপেনে। ১৯৭৭ সালের পর গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে মেজর কোন শিরোপার দেখা পেলেন তিনি। আসরের শুরু থেকেই চমকপ্রদ পারফর্মেন্স উপহার দিয়ে দীর্ঘ ৪৪ বছরের খরা কাটিয়ে মহিলা এককে গ্রেট ব্রিটেনকে প্রথম কোন গ্র্যান্ড স্লোম উপহার দিলেন রাদুকানু। শুধু তাই নয়, ফ্ল্যাশিং মিডোসে ১৯৬৮ সালে ব্রিটেনের শেষ কোন প্রমিলা খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন ভার্জিনিয়া ওয়েড। তার দীর্ঘ ৫৩ বছর পর ইউএস ওপেন থেকে ব্রিটেনকে ট্রফি এনেও দিলেন রাদুকানু। মারিয়া শারাপোভার পর সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মেজর টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কীর্তিটাও এই ব্রিটিশ তরুণীর। তার আগে ২০০৪ সালে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডনের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন রাশিয়ান টেনিসের সাবেক শীর্ষ তারকা শারাপোভা। এখানেই শেষ নয়? গত অর্ধযুগের মধ্যে এই প্রথম কোন সেটে না হেরেও ইউএস ওপেনের শিরোপা উঁচিয়ে ধরার নজিরও গড়লেন রাদুকানু। তার আগে এমনভাবে ফ্ল্যাশিং মিডোসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সেরেনা উইলিয়ামস। ২০১৪ সালে এই রেকর্ড গড়েছিলেন আমেরিকান টেনিসের জীবন্ত কিংবদন্তি। সেরেনা উইলিয়ামসের পর এবার সেই রেকর্ড গড়লেন রাদু। সপ্তাহ তিনেক আগেও ইউএস ওপেনে রাদুকানু চ্যাম্পিয়ন হবে বললে হয়ত পাগলের প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দেয়া হতো। এমনকি রাদুকানু নিজেও তা কল্পনায় আঁকেননি। মজার ব্যাপার হলো, দুই সপ্তাহ আগে তো দেশে ফেরার বিমানও বুকিং করে রেখেছিলে তিনি। ধারণা ছিল কোয়ালিফাইং রাউন্ডের পরই যদি নিউইয়র্ক ছাড়া লাগে তার। সেই বিশ্বাস থেকেই বিমানের টিকেট বুকিং করে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু নিয়তির কী রীতি! ১৭ দিন পরই গ্যালারি ভর্তি উচ্ছ¡াসিত দর্শকদের সামনে উঁচিয়ে ধরলেন বিশ্ব টেনিসের অন্যতম মর্যাদার এই ট্রফি। গর্বিত করলেন তার দেশ ইংল্যান্ডকেও। তাও আবার চমকপ্রদ-মনোমুগ্ধকর পারফর্মেন্সের সৌজন্যেই। পুরো টুর্নামেন্টে একটা সেটও না হেরে। ইউএস ওপেনে ১৭ দিনের স্বপ্নময় পথে ১০টি ম্যাচ খেলেছেন রাদুকানু। তিনটি কোয়ালিফায়ারে। আর বাকি সাতটি মূল প্রতিযোগিতায়। এই পথে বেশ কিছু তারকা খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। ফাইনালে উঠার পথে টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী বেলিন্ডা বেনচিচ এবং গ্রীক তারকা মারিয়া সাক্কারিকেও পরাজিত করেন তিনি। আর শিরোপা জয়ের পথে রাদুকানু থামান অপ্রতিরোধ্য লেইলা ফার্নান্দেজকে। মোটকথা উড়ন্ত জয় দিয়েই তার পূর্ণতা দিলেন ১৫০তম স্থানে থাকা রাদুকানু। অপ্রতিরোধ্য এই যাত্রায় কিছুটা শঙ্কা জেগেছিল ফাইনালে এসে। দ্বিতীয় সেটে ৫-৩ গেমে এগিয়ে থাকার সময় পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। মেডিক্যাল টাইম আউট নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। স্বপ্নযাত্রার শেষটা করেন দুর্দান্ত এক এইস দিয়ে। ইউএস ওপেনে এবার দেখা গেছে তারুণ্যের দাপট। মহিলা এককের মতো পুরুষ এককেও দাপট দেখা গেছে। তবে পুরুষ এককে তরুণদের দাপট থেমে গেছে ফাইনালের আগেই। কিন্তু মেয়েদের এককে ফার্নান্দেজ আর রাদুকানুকে কেউ থামাতে পারেননি। অথচ, আসরের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন নাওমি ওসাকা থেকে শুরু করে সাবেক চ্যাম্পিয়ন বিয়াঙ্কা আন্দ্রেস্কু, এ্যাঞ্জেলিক কারবার, শীর্ষ তারকা এ্যাশলে বার্টি, ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা, পেত্রা কেভিতোভা, এ্যারিনা সাবালেঙ্কা, বারবোরা ক্রেসিকোভা, ইগা সুইয়াটেক, সিমোনা হ্যালেপ, এ্যালিনা সিতলিনা, ক্যারোলিনা পিসকোভা কিংবা গারবিন মুগুরুজাও খেলেছেন নিউইয়র্কে। কিন্তু সবাই থেমে গেলেও রাদুকানু-ফার্নান্দেজ তাদের জাদুতে জায়গা করে নেন নিউইয়র্কের ফাইনালে। এর ফলে ১৯৯৯ সালের পর এবারই প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল দুই অবাছাই খেলোয়াড়। দীর্ঘ ২২ বছর আগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই অবাছাই সেরেনা উইলিয়ামস ও মার্টিনা হিঙ্গিস। যেখানে শেষের হাসিটা হেসেছিলেন সেরেনাই। এই দুজনই পরে বড় তারকা হয়েছিলেন। রাদুকানু-ফার্নান্দেজ কী তাহলে সেই পথেই হাঁটবেন? এর সঠিক উত্তর অবশ্য সময়ের হাতে। তবে রাদুকানুকে নিয়ে ইতোমধ্যেই বড় স্বপ্ন বুনছেন টেনিসবোদ্ধারা। ইউএস ওপেন জয়ের পর প্রাইজমানি হিসেবে রাদুকানু পাচ্ছেন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। পাশাপাশি বিশ্ব টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়েও ছাপ ফেলছে তার এই অনন্য কীর্তি। ইতোমধ্যেই তিনি উঠে গেছেন বিশ্ব টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়ের ২৩ নম্বরে। সোমবার গ্রেট ব্রিটেনের টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থানটিও দখল করে নিয়েছেন তিনি। এর আগে বিশ্ব টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়ের ৩৩৬ নম্বর খেলোয়াড় ছিলেন রাদুকানু। গত ২৩ আগস্ট তার অবস্থান ছিল ক্যারিয়ারের সেরা ১৫০। সেবার উইম্বলডনের পারফর্মেন্স ছিল নজরকাড়া। দারুণ খেলে উইম্বলডনের চতুর্থ রাউন্ডে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইনজুরি। যে কারণে টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন রাদু। তবে ইউএস ওপেনে আর থামেননি গ্রেট ব্রিটেনের এই তরুণী। ইউএস ওপেনের পর তাকে নিয়ে শুরু হয়ে গেছে বিস্তর গবেষণা। গ্রেট ব্রিটেন তো বটেই বিশ্ব টেনিসেই তার বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিপণন ও স্পন্সরশিপ বিশেষজ্ঞ নাইজেল কুরি এক সাক্ষাতকারে বলেন, রাদুকানু ‘বিপণন জগতের একটি স্বপ্ন এবং এই ১৮ বছর বয়সীর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য বিজ্ঞাপনদাতা এবং স্পন্সররা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।’ মার্কেটিং বা বিপণন খাতে রাদুকানুর বয়স, তার প্রজন্ম- জেন জি, দ্বৈত ঐতিহ্য, তার ক্রমবর্ধমান প্রোফাইল, বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা প্রাধান্য পাবে বলে মনে করছেন এমলিয়ন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক সাইমন চ্যাডউইক। তিনি বলেন, ‘বড় বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে অনেক চুক্তির সুযোগ পাবে এমা।’ আর কুরি বলেন, ‘নাইকি এবং এ্যাডিডাস তার চুক্তির জন্য লড়াই শুরু করে দিবে।’ এসব চুক্তির পর বদলে যাবে তার আয়ের গল্পটাও।
×