ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তৃপ্তির ঢেকুর এবং প্রশ্নবিদ্ধ প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ২১:২৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

তৃপ্তির ঢেকুর এবং প্রশ্নবিদ্ধ প্রস্তুতি

ক্রিকেটে সেরা পরিসংখ্যান সব সময় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে না। ধরুন এলিট শ্রেণীর একজন ব্যাটসম্যান তার সেঞ্চুরির শতকার ৭০-৮০ ভাগই করলেন সহযোগী কোন দেশ অথবা নিচু সারির দলের বিপক্ষে। কোন বোলার আবার ইনিংসে ৬-৭টা উইকেট নিয়ে রেকর্ড চুরমার করে দিলেন, দেখা গেল প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান অত্যন্ত বাজে শটে তাকে উইকেট উপহার দিয়ে গেছেন, হয়ত অতিমানবীয় ফিল্ডিংয়ে কৃতিত্বের বড় অংশ ফিল্ডারের প্রাপ্য। গোলকধাঁধা বৈকি! যে গোলকধাঁধায় পড়েছে টাইগারদের টি২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি! টানা তিন সিরিজ আর ১৩ ম্যাচের ৯টিতে জিতেও আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের দল। কারণ এই নয় জয়ের ৭টিই এসেছে ঘরের মাঠে, প্রশ্নবিদ্ধ স্লো উইকেটে, স্পিনের ফাঁদ পেতে অস্ট্রেলিয়া ও দ্বিতীয় সারির নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ টি২০ বিশ্বকাপ হবে আরব আমিরাতে, বিশ্বের অন্যতম স্পোটিং উইকেটে। ইতিহাস বলে শারজাহ, আবুধাবি ও দুবাইয়ে রানের বন্যা বয়ে যাবে। ১৭০-১৮০ রানের ইনিংসের দেখা মিলবে হর-হামেশা। দুই শ’ও ছাড়িয়ে যাবে কখনও কখনও। চার-ছক্কার নাচন তুলবেন রোহিত শর্মা, বাবর আজম, ক্রিস গেইলরা। অথচ শুধু জয়ের কথা ভেবে মিরপুরে বাংলাদেশ খেলল টার্নিং উইকেটে। সাকিব আল হাসানের মতো সুপারস্টারও বললেন, এমন উইকেটে কোন ব্যাটসম্যান ১০-১৫টা ম্যাচ খেললে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে! খোদ বোর্ড (বিসিবি) প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান সন্দিহান, সিরিজ তো জিতলাম কিন্তু টি২০’র প্রস্তুতি কতটা হলো! ‘এই ৯-১০টা ম্যাচ যারা খেলেছে সবাই অফ ফর্মে আছে। উইকেটটাই এমন। এখানে কেউ খুব একটা ভাল করেনি। এরকম উইকেটে কোন ব্যাটসম্যান ১০-১৫টা ম্যাচ খেললে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে’, বলছিলেন সাকিব। মিরপুরের উইকেট কতটা বিরুদ্ধ ছিল ওপেনার লিটন দাসের বক্তব্যেও সেটি ফুটে উঠেছে, ‘টি২০তে সবসময় স্কোর বড় করার বা স্ট্রাইক রেট ঠিক রাখার মানসিকতা থাকে। যেহেতু এ জিনিসটা হচ্ছে না, পরিকল্পনা পাল্টাতে হচ্ছে। কিন্তু এটা কঠিন। টি২০ ক্রিকেটে এমন উইকেটে মানিয়ে নেয়া কঠিন। কারণ প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই আক্রমণাত্মক মেজাজে থাকে।’ ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়া মোহাম্মদ আশরাফুলও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না, ‘জয় যেমন অভ্যাসের ব্যাপার, ব্যাটসম্যানদের রান করাও কিন্তু অভ্যাসের ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতেছি, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও জিতলাম। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা তো রান করছে না। উল্টো নিজেদের সুবিধামতো করে তৈরি উইকেটেই ৭৬ রানে গুটিয়ে যেতে হয়েছে। টি২০ বিশ্বকাপের আগে এটা কিন্তু ভাল হলো না। জয়ের অভ্যাস সব সময়ই ভাল। সেদিক দিয়ে ঠিক আছে। কিন্তু যে ধরনের উইকেটে খেলে জয়গুলো এলো, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে আমিরাত আর ওমানে সেটি কাজে আসবে কিনা! সেখানে তো স্পোর্টিং উইকেটে খেলতে হবে।’ ৫ ম্যাচের ৪টিতে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে সাকিব করেছেন ২৫, ১২, ০ ও ৮। লিটন ৫ ম্যাচে করেছেন ১, ৩৩, ১৫, ৬ ও ১০ রান। মুশফিক ছিলেন পুরোপুরিই ব্যর্থ। তিনি করেছেন ১৬*, ০, ২০*, ০ ও ৩ রান। ৩ ম্যাচে নামার সুযোগ পেয়ে নুরুল হাসান সোহান করেছেন ১৩, ৮ ও ৪ রান। একমাত্র ধারাবাহিক নাইম শেখের ব্যাট থেকে এসেছে- ১, ৩৯, ১৩, ২৯ ও ২৩ রান। কিউইদের বিপক্ষে পঞ্চম ম্যাচে কিছুটা ব্যাটিং সহায়ক উইকেট থাকলেও ব্যর্থতা কাটাতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তবে গত ১০ ম্যাচের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪৯ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন আফিফ হোসেন ধ্রæব। মাত্র ৩৩ বলে করা তার এই ইনিংসটিই বাংলাদেশের পক্ষে গত ১০ ম্যাচে টি২০ ক্রিকেটের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাকিব ৫ ম্যাচে ১১৪, আফিফ ১০৯ রান করেছিলেন। আর কেউ ১০০ রানও করতে পারেননি। নিউজিল্যান্ড দলের হয়ে সিরিজে ২ হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন টম লাথাম। অথচ পরিচিত এই পরিবেশে বাংলাদেশের কেউ অর্ধশতক হাঁকাতে পারেননি। মাহমুদুল্লাহ ১২০, নাইম ১০৫ রান করেছেন। আফিফ সর্বশেষ ম্যাচে ভাল করলেও বাকি ৩ ম্যাচে ব্যাট হাতে মাত্র ৯ রান করেছেন। সবমিলিয়ে তাই এ দুটি সিরিজ থেকে এখন বিশ্বকাপের আগে ব্যাটিং ব্যর্থতাই বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যথা। ব্যাটিং নিয়ে এমন হতাশার মাঝে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর আত্মবিশ্বাসই হতে পারে বড় প্রেরণা। দুজনেই জয়ের অভ্যাসটাকে বড় করে দেখছেন, ‘টানা তিনটা সিরিজ জয়ের পথে আমরা খুব ভাল ক্রিকেট খেলেছি। এই সাফল্য আমাদের উজ্জীবিত করবে। আশা করি এখান থেকে গুছিয়ে উঠে বিশ্বকাপেই ফের জিততে শুরু করব।’ বলেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। ভরসা দিচ্ছেন টাইগার ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসানও, ‘ভালর দিকে যদি তাকান, তাহলে অনেক কিছু দেখতে পাবেন। আমার কাছে মনে হয় সব ক্রিকেটার কম বেশি পারফর্মেন্স করছে এবং একটা দল হিসেবে খেলতে পারছি। আমার কাছে তো মনে হয় ভাল সুযোগ আছে (বিশ্বকাপে)। এর বড় কারণ হচ্ছে গত তিনটা সিরিজ আমরা জিততে পেরেছি। একটা দল যখন জিততে থাকে, জয়ের মানসিকতা থাকে, তা অন্য পর্যায়ের আত্মবিশ্বাস দেয়।’ আমিরাতে এ মাসের ১৯ তারিখ শুরু আইপিএলের বাকি অংশ। সেখানে অংশ নিতে এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছেন সাকিব ও আরেক তারকা মুস্তাফিজুর রহমান। এটি বিশ্বকাপে কাজে লাগবে বলে মনে করেন সাকিব, ‘আইপিএলটা দারুণ কাজে লাগবে। কারণ এই পরিবেশেই আমাদের বিশ্বকাপে খেলতে হবে। মুস্তাফিজ এবং আমি অভিজ্ঞতা দলের সঙ্গে ভাগ করে নেব।’ উল্লেখ্য, ১৫ অক্টোবর আইপিএল শেষ হওয়ার একদিন পর ১৭ অক্টোবর শুরু টি২০ বিশ্বকাপ। ওমানের মাস্কাটে রাউন্ড-১ এর ম্যাচে প্রথম দিনেই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড। ঘরের মাঠে মনের মতো পিচে দ্বিতীয় সারির নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া নয় প্রত্যাশা মতো বিশ্বকাপের সুপার ১২-এ উঠলে বাংলাদেশকে খেলতে হবে টি২০র পাওয়ার হাউসদের সঙ্গে। নাসুম আহমেদ-শরিফুল ইসলামদের বল কতে হবে রোহিত শর্মা-বাবর আজমদের বিপক্ষে। মুশফিকুর রহিম-মোহাম্মদ নাইমদের মোকাবেলা করতে হবে জাসপ্রিত বুমরাহ-রশীদ খান-শাহিন শাহ আফ্রিদিদের বল। বাস্তবতার জমিনের সঙ্গে এই প্রস্তুতির ব্যবধান কতটা, ওমানের প্রথম রাউন্ডের গ্রুপ-বি এর সেরা হয়ে আরব আমিরাতে পা রাখলেই সেটি টের পাওয়া যাবে। যেখানে গ্রুপ পর্বেই রেডি হয়ে আছে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নিউজিল্যান্ড; স্মরণযোগ্য এই নিউজিল্যান্ড নয়, সেটা কেন উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড, যারা টানা দু’দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে টি২০ সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত। ওমানে প্রস্তুতি ক্যাম্প এবং রাউন্ড ওয়ানের তিনটি ম্যাচই এখন বড় ভরসা দুর্বল প্রতিপক্ষ। জয় নিয়ে হয়ত খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বিশ্বকাপের আবহে ওখানকার কন্ডিশনে সেটা কিভাবে আসে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের পারফর্মেন্স এবং ঘরের মাঠে স্লো উইকেটে দাপট দেখানো স্পিনাররাই বা সেখানকার স্পোর্টিং উইকেটে কেমন করে। ভাগ্য ভাল যে বাংলাদেশ বি-গ্রুপে পড়েছে, যেখানে প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড, পিএনজি ও ওমান। অথচ এ-গ্রুপে আছে শ্রীলঙ্কা, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দল। বাংলাদেশের টি২০ বিশ্বকাপ দল ॥ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (অধিনায়ক), সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, লিটন কুমার দাস, আফিফ হোসেন ধ্রুব, মোহাম্মদ নাইম শেখ, নুরুল হাসান সোহান, শামীম হোসেন পাটোয়ারী, মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, শরিফুল ইসলাম, শেখ মেহেদী হাসান ও নাসুম আহমেদ। স্ট্যান্ডবাই ॥ রুবেল হোসেন, আমিনুল ইসলাম বিপ্লব। প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশের তিন ম্যাচ ১৭ অক্টোবর : বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড, মাস্কাট (রাত ৮টা) ১৯ অক্টোবর : ওমান-বাংলাদেশ, মাস্কাট (রাত ৮টা) ২১ অক্টোবর : বাংলাদেশ-পাপুয়া নিউগিনি, মাস্কাট (বিকেল ৪টা)
×