ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মোহ সত্য প্রকাশে নির্ভীক শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ২০:২১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

নির্মোহ সত্য প্রকাশে নির্ভীক শেখ হাসিনা

অনেক আলোচনা ও কর্মসূচীতে শেষ হয়েছে শোকের মাস। মাস শেষ হলেও হৃদয়ের যন্ত্রণা শেষ হবে না কোনদিন, কারণ ক্ষতটা অনেক গভীর। শতাব্দীকাল বাঙালী জাতি রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। একই সঙ্গে বঞ্চিত ছিল নাগরিক হয়ে উঠার সুযোগ থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকারহারা জাতিকে আধিকারিক করেছিলেন। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালীর হাতে সপরিবারে নিহত হন তখন নানা প্রশ্ন জাগে। কেন হত্যা করা হলো, হত্যাযজ্ঞে অনুঘটকের ভূমিকায় কারা ছিল- এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া খুবই দরকার। তা না হলে আমাদের ইতিহাস পরিপূর্ণ হবে না। পরিপূর্ণ ইতিহাসই সমৃদ্ধির জায়গা তৈরি করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যিনি শুধু জাতির পিতাই নন, একই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁর অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হন তিনি। এরপর কত ইতিহাস, কত কাহিনীর জন্ম হয়। ৭৫ পরবর্তী টানা ২১ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বাঙালী জাতি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তারা বিপন্ন দিনগুলো পার করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। নানা কারণে আওয়ামী লীগ ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ যেন বিবর্ণ বদ্বীপে পরিণত হয়। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়ে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিতির দিকে এগিয়ে যায় এই দেশ। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার ৬ বছর পর শেখ হাসিনা স্বদেশে ফেরেন। তার স্বদেশে ফেরার আগেই গণতান্ত্রিক পন্থায় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার মানসে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। বেদনাকাতর শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেন। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে। উন্মোচিত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের বিচারের দ্বার। বিচার সম্পন্ন হলেও রায় কার্যকরে সময় লেগে যায়। আটকে যায় রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে জনতার বিপুল সমর্থনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফেরে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়ন হয়। সেই থেকে এখনও ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এই দলটি। টানা তিন দফায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে দেশে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন হলেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি রং বদলে আওয়ামী লীগে মিশে গিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- তথা ’৭৫-এর হত্যাকা-ে যারা সশরীরে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের বিচার হয়েছে, সাজা হয়েছে। পালিয়ে থাকা ঘাতকদের রায় কার্যকর এখনও বাকি আছে। ঘাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে যারা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে তাদের বিচার হয়নি। কারা মূল পরিকল্পনাকারী, হত্যাকারীদের শক্তির উৎস কোথায় ছিল সেই প্রশ্নগুলো এখন সামনে আসছে। এত বছর পর সেই সত্যগুলো নির্মোহভাবে সাহসিকতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রকাশ করছেন। শোকের মাসে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানই ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের মূল শক্তি। এখনও যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের খুনী ও ফাঁসির আসামিদের সন্তানরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে যেসব আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল তাদের অনেকেই এদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে কিছু লোক সব সময় পদলেহনকারী। এই চাটুকারের দল সব সময় নিজের দেশের এবং নিজের মানুষের ভাগ্য নিয়েও ছিনিমিনি খেলছে। সব সময় আঁতাত করে আমাদের দেশের সর্বনাশ করেছে। ’৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন স্থানীয় দালালচক্র তাদের সহযোগিতা করেছে। তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। বিজয়ের পর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে জাতির জনককে হত্যা করে। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়।’ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আজ জাতি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি। শেখ হাসিনা স্পষ্ট বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরসূরি ও ’৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের উত্তরসূরির পাশাপাশি ২০০৪-এর ২১ আগস্ট হত্যাকা-ের কুশীলবরা এখনও সক্রিয়। বর্ণচোরার মতো বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে তারা। অপশক্তির কেউ কেউ ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করে মহাচাটুকারিতায় লিপ্ত থেকে শেখ হাসিনার মনের গভীরে জায়গা করে নেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা ঠিকই তা বুঝতে পারেন। সময়মতো এদের মুখোশ উন্মোচন হবেই। এত বড় একটি সংগঠন আওয়ামী লীগ, প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও রয়েছে নির্মোহ কর্মী-সমর্থক, অথচ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডর পর কোনরূপ প্রতিরোধ-প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি কেন? এ প্রশ্নটিও শেখ হাসিনা সামনে নিয়ে এসেছেন। এর মূল রহস্য কী ছিল? সেই সময়কার আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বঙ্গবন্ধু তখনও সাধারণ মানুষের কাছে সমভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদ যে একেবারে হয়নি তা কিন্তু নয়। গ্রামেগঞ্জে তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিবাদ হয়েছে, মিছিল হয়েছে। তখন দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো কোন নেতার খোঁজ মেলেনি। তখন যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তারা মোশতাক-জিয়া-এরশাদের আমলে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেদিন যারা প্রতিবাদী ছিলেন তাদের কেউ শেখ হাসিনার কাছাকাছি নেই। কাছাকাছি না থাকলেও এরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেই পথ চলে আসছেন। ’৭৫ পরবর্তী সুবিধাভোগীরা এখনও সুবিধার মধ্যেই আছেন। তাদের উত্তরসূরিরা ব্যাপক স্বাচ্ছন্দ্যে দিন যাপন করছে। শেখ হাসিনা সবই জানেন এবং বোঝেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত নামক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার আছে কী না? যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মানে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে না তাদের তো এদেশে নাগরিক অধিকার থাকাও উচিত নয়। বঙ্গবন্ধুকে না মানার অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। স্বাধীনতাকে অস্বীকার মানে দেশদ্রোহিতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কুশীলবদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এর জন্য নিরপেক্ষ কমিশনের কথা বলা হচ্ছে। অবশ্য এ কথা আরও অনেকবার শুনেছি। প্রতিবছর শোকের মাসেই এসব আলোচনা হয়। একটা বিষয় লক্ষণীয়, এবার শেখ হাসিনার সত্য প্রকাশের পর এখন অনেকেই এসব সত্য কথা বলছেন। এর আগে তারা এনিয়ে কোন কথা বলেননি। এখন কে কার আগে কত বেশি এসব কথা বলতে পারেন তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে এখনও কিছু অপশক্তির জাল বিভিন্নভাবে বিস্তৃত রয়েছে। এরা সুযোগ পেলেই দেশের অমঙ্গল ঘটায়। আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা এদের পছন্দ করে না। এসব অপশক্তিকে নির্বাসনে পাঠাতেই হবে। স্বাচ্ছন্দ্য মঙ্গলময় পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই শেখ হাসিনা নির্মোহ সত্য প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তিনি মূল সমস্যা চিহ্নিত করেই এগিয়ে যাবেন। আমাদের মূল সমস্যা মানবিক উৎকর্ষের অভাব। মানবিক উৎকর্ষ বিধানে সত্য উদ্ঘাটন করা জরুরী। তবেই ইতিহাস গতিময় হবে। বাঙালী সত্যিকারের ঠিকানা খুঁজে পাবে। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×