ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শরতের শোভা শাপলা-পদ্ম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

শরতের শোভা শাপলা-পদ্ম

যে কোন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় প্রতীকগুলো। মূলত এ জন্যই জাতীয় প্রতীক নির্বাচন করা হয়ে থাকে। সে মতে বাংলাদেশেরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের জাতীয় প্রতীক। প্রতীকগুলোকে জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যেমন- জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত, স্মৃতিসৌধ, খেলাধুলা, বন, পশু-পাখি, গাছ, মাছ, ফল ও ফুল। তেমনি ফুলের ক্ষেত্রে শাপলাকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মূলত সহজলভ্য, দৃষ্টিনন্দন ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে শাপলা জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি বছরের বেশিরভাগ সময় জলে নিমজ্জিত থাকে। যেমন- পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, নদীনালা ইত্যাদি। জলজ পরিবেশে যেসব উদ্ভিদ জন্মায়, তা বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভিদ। যেমন-শাপলা। শাপলা ফুল বছরের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া দেখা যায় না। শুধু বর্ষা মৌসুমে নিচু জলাভূমিতে শাপলা জন্মে। বলা যায়, কোন রকম চাষাবাদ ছাড়াই উদ্ভিদটি অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠে জলাশয়ে। স্রোতবিহীন জলাশয়ের কাদামাটিতে প্রোথিত থাকা শালুক থেকে শাপলার জন্ম হয়। বর্ষার জল বাড়লেই শালুক থেকে গুল্মজাতীয় সরু নল বেরিয়ে থালাকৃতির পাতাসমেত জলের ওপর ভেসে থাকে গাছটি। ঠিক তার নিচ দিয়ে গজিয়ে ওঠে কিছু মোটাসোটা গোলাকৃতির ফাঁপা ডাঁটা, যার মাথায় থাকে ডিম্বাকৃতির কলার মোচার মতো কুঁড়ি। সেই কুঁড়ি ফুটলেই নাম ধারণ করে শাপলা। সাধারণত তিন প্রজাতির শাপলা জন্মে বাংলাদেশে। যেমন- : লাল, নীল ও সাদা। তার মধ্যে সাদা শাপলা বেশ আকর্ষণীয় ও মনোহরণকারী। আর এই আকর্ষণীয় ধবধবে সাদা শাপলাই বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। শাপলা ফুলের আয়ুষ্কাল এক সপ্তাহের কিছু বেশি। অন্য সব ফুলের মতো শাপলা সব সময় প্রস্ফুটিত থাকে না। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রস্ফুটিত থাকে। আর ফুল ফোটে রাতের আঁধারে। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পাপড়িগুলো সঙ্কুচিত হয়। সঙ্কুুচিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার মধ্যে দারুণ এক বিষয় লক্ষ্য করা যায় তখন। আর সেটি হচ্ছে, যে ফুলের পাপড়ি যে সময়ে প্রস্ফুটিত হয়, পরের দিন সেই ফুলের পাপড়ি ঠিক এক ঘণ্টা পর প্রস্ফুটিত হয়। আবার সেটি সঙ্কুচিতও হয় ঠিক এক ঘণ্টা পর। বিষয়টা মজারই বটে। দুই বাংলা ছাড়া সাদা শাপলা বিশ্বের আর কোথাও ব্যাপকভাবে নজরে পড়ে না। তবে মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, ইয়েমেন, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার জলাশয়ে নজরে পড়ে। গুল্মজাতীয় এ উদ্ভিদটি বিশ্বের অন্যান্য দেশে দুর্লভ হলেও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বিশেষ করে পুকুর-ডোবায় বেশ সহজেই জন্মে। সহজলভ্যতার কারণেই হয়তবা শাপলার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না দেশে। অনুরূপ পদ্মের ক্ষেত্রেও। পদ্মকে বলা হয় পূজার ফুল। দেশের মানুষ হাতের নাগালে পেয়ে নির্বিচারে শাপলা ও পদ্ম অবাধে নিধন করে যাচ্ছে। শুধু রসনা বিলাসের জন্য বহু যুগ ধরেই শাপলা সবজি হিসেবে খাচ্ছে মানুষ। মৌসুমে জাতীয় মাছের সঙ্গে জাতীয় ফুলের সবজি না হলে যেন জমেই না তাদের। এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে জাতীয় ফল, জাতীয় মাছ খেতে দোষ নেই, ফুলের ক্ষেত্রে এত কথা আসছে কেন? আসলে বিষয়টা সেখানে নয়; বিষয় হচ্ছে, জাতীয় ফল ও জাতীয় মাছের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়, সে ধরনের কোন উদ্যোগই নেয়া হয় না শাপলার বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে। বরং সম্পূর্ণ উল্টোটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শাপলা, শালুক, ডাঁটা, ভেটসুদ্ধ খাচ্ছে। এক কথায় এ উদ্ভিদের গোড়া থেকে আগা অবধি সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলছে মানুষ। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দেশে পর্যাপ্ত সবজির চাষাবাদ হওয়া সত্ত্বেও শাপলা খাচ্ছে মানুষ। অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার জোগান দিয়ে সবজি বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। এতে প্রমাণ হয় যে, সবজির সঙ্কটে শাপলা খাচ্ছে না কেউ; খাচ্ছে রসনাবিলাসের কারণে। অথবা, ‘সবাই যখন খাচ্ছে, নিজেও একটু খেয়ে দেখি’- বিষয়টা এ রকমও হতে পারে। সে জন্য বলা যায়, শাপলা সবজি হিসেবে খেতে হলে জাতীয় মাছের মতো সংরক্ষণ করেই খেতে হবে। তবে না খাওয়াই উত্তম। শাপলা বাংলাদেশের মুদ্রা ও পোস্টকার্ডসহ নানা জায়গায় স্থান করে নিতে সক্ষম হলেও, দেশের সর্বসাধারণের কাছে ওইভাবে গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেলে অবাধে শাপলা নিধন করতেন না কিংবা পদতলে পিষ্ট করতেন না মানুষ। দেখা যাচ্ছে দেশের মানুষ যেভাবে শাপলা খাচ্ছে, তাতে অচিরেই এই উদ্ভিদটি হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিষয়টি অনুধাবন করে দেশের গণমাধ্যমগুলো বারবার শাপলা বিনষ্টের অশনিসঙ্কেত জানিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছেও। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বিশ্বের আর কোন দেশের মানুষই তাদের দেশের জাতীয় ফুল খায় না, একমাত্র বাংলাদেশের মানুষ ছাড়া। শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল নীল শাপলা হলেও যতটা জানা গেছে, তা তারা খায় না। এসব ছোটখাটো বিষয়গুলো চিন্তা করে হলেও দেশের মানুষের শাপলাপ্রীতি বেড়ে যাওয়া উচিত। প্রীতি, ভালবাসা না বাড়লে একদিন শাপলার অস্বিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে শাপলা ফুল চিনাতে হলে শরণাপন্ন হতে হবে ইন্টারনেটের। এখানে আরেকটি বিষয় বলার আছে। শুধু যে শাপলার সবজি খেয়ে অস্বিত্ব সঙ্কটে ফেলা হচ্ছে তা নয়, আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানাতেও শাপলা ব্যাপকভাবে নিধন করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের কৃষি জমিতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলেও শাপলার বীজ অর্থাৎ শালুক ধ্বংসের সম্মুক্ষীণ হচ্ছে। আবার লাঙল অথবা ট্রাক্টরের ফলার আঁচড়েও শালুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে পচে যাচ্ছে। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা জলাশয় ভরাটের কারণেও শাপলা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে। যা হয়েছে পদ্ম ফুলের ক্ষেত্রেও। এমতাবস্থায় এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে জনসচেতনা বৃদ্ধি করে শাপলা ও পদ্ম সংরক্ষণ করা। তবেই দেশের জাতীয় ফুলের সুরক্ষা মিলবে। নচেত চোখের সামনেই এই উদ্ভিদ তথা জাতীয় ফুল হারিয়ে যাবে একদিন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকই হারিয়ে যাবে না, পরিবেশের ভারসাম্যও বিনষ্ট হবে। বিশেষ করে বিল-হাওড়-বাঁওড়ের মাছের খাবার, প্রজনন ও অভয়াশ্রম সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটবে। গবেষণায় জানা গেছে, প্রাকৃতিক কারণেই শাপলা-পদ্ম অধ্যুষিত জলাশয়ে মাছ বৃদ্ধি পায় দ্রুতগতিতে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে, শাপলা গাছের পাতায় ও ফুলে নানা প্রজাতির পতঙ্গের আনাগোনার ফলে মাছ তার খাদ্যের জোগান পায় সঠিকভাবে। এ ছাড়াও ফসল পায় উৎকৃষ্ট জৈবসার। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে অবাধে শাপলা-পদ্ম নিধন বন্ধ করতে হবে। তাতে জাতীয় প্রতীক টিকে থাকার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকবে। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×