ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষির যান্ত্রিকীকরণ নতুন যুগের সূচনা

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

কৃষির যান্ত্রিকীকরণ নতুন যুগের সূচনা

প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের কৃষি আগের তুলনায় অনেক আধুনিক। কৃষিতে যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক ফসল রোপণ, কর্তন এবং প্রক্রিয়াকরণের যন্ত্রপাতি। বিশেষ করে ট্র্যাক্টর, কম্বাইন হারভেস্টার, ট্রান্সপ্লান্টার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতিতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্তির ফলে কৃষি কাজ আরও সহজ এবং বহুমাত্রিক। সাম্প্রতিক সময়ে, জিপিএস, ওয়েদারট্র্যাকিং, স্যাটেলাইট ইমেজিং প্রভৃতি প্রযুক্তি কৃষিতে স্বয়ংক্রিয়তা নিয়ে এসেছে। এখন চালকবিহীন ট্রাক্টর রয়েছে যা স্মার্টফোন বা অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইসে মোবাইল এ্যাপ ব্যবহার করে চালানো যায়। কম্পিউটারাইজড ওয়েদার মডেলিং কৃষির জন্য অনলাইন আবহাওয়া পরিষেবা প্রদান করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ক্রমবর্ধমান এবং পরিশীলিত (Sophisticated) হচ্ছে- যা আবহাওয়ার সার্বিক অবস্থা যেমন বৃষ্টি, তাপমাত্রা, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত এবং এই ধরনের পূর্বাভাস প্রদান করে। এই পূর্বাভাস কৃষকদের আরও সতর্কতা অবলম্বন এবং ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে সহযোগিতা করছে। স্যাটেলাইট ইমেজিংয়ের মাধ্যমে শস্যের উচ্চ রেজ্যুলিউশন সম্পন্ন রিয়েল-টাইম ইমেজ পাওয়া সম্ভব, যা যথেষ্ট সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে একজন কৃষককে শারীরিকভাবে শস্যের জমিতে উপস্থিত না হয়েও ঘন ঘন ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। কৃষি ড্রোন। বাংলাদেশেও স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে। এটি একজন কৃষককে আকাশ থেকে তাদের শস্য খেতের অবস্থা দেখতে সহায়তা করে থাকে। কৃষি ড্রোনের বার্ডস আই ভিউ শস্যের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে জমির আর্দ্রতার অবস্থা, মাটির গুণাগুণের তারতম্য, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ এবং ছত্রাকের উপদ্রব সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে থাকে। মাল্টিস্পেক্ট্রাল ইমেজ একটি এনআইআর (NIR-Near Infrared) দৃশ্যের পাশাপাশি একটি ভিজ্যুয়াল বর্ণালি দৃশ্যও প্রকাশ করে। নিয়ার ইনফ্রারেড (এনআইআর) হলো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রামের ইনফ্রারেড ব্যান্ডের একটি উপসেট, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ০.৭ থেকে ১.৪ মাইক্রন পর্যন্ত। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য-মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টি সীমার বাইরে এবং কখনও কখনও দৃশ্যমান লাইট ইমেজিংয়ের মাধ্যমে যা দেখতে পাওয়া যায় তার চেয়ে স্পষ্ট বিবরণ প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে দৃশ্যমান আলোর বর্ণালি হলো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বর্ণালির সেগমেন্ট যা মানুষের চোখ দেখতে পারে। সাধারণত, মানুষের চোখ ৩৮০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্য শনাক্ত করতে পারে। কৃষি ড্রোনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইমেজ বিশ্লেষণ করে ফসল বৃদ্ধি এবং উৎপাদন মূল্যায়নের কাজ করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বের দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে- কৃষি প্রযুক্তি একটি নতুন দৃষ্টান্তের দিকে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এই দৃষ্টান্তের মধ্যে, ডিজিটালাইজেশন, অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগাছা দমন, রোগবালাই এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণসহ ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই বিবর্তনে একদিকে যেমন অনেক সুবিধা বিদ্যমান অন্যদিকে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। যেমন ট্রাক্টর এবং ইঞ্জিন শক্তির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি এবং রোবটিক্সের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা এবং নির্ভুলতা নিশ্চিত করা। তারপরও বিশ্বব্যাপী কৃষি দ্রুত একটি হাইটেক শিল্পে পরিণত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন পেশা, নতুন কোম্পানি এবং আকৃষ্ট হচ্ছে নতুন বিনিয়োগকারী। সবই নিরাপদ এবং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৭.৯ বিলিয়ন থেকে ২০৫০ সালে ৯.৭ বিলিয়নে উন্নীত হবে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন হবে অনেক খাদ্যের। এই অতিরিক্ত খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্য শস্য উৎপাদনকারীদের বেশি চাপের মুখোমুখি হতে হবে। এই চাপ নিরসনে প্রধান ভূমিকা রাখবে ‘কৃষি রোবট’। কৃষি রোবট বিভিন্ন উপায়ে কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করবে। উন্নত বিশ্বে স্বল্প পরিসরে ড্রোন থেকে স্ব-চালিত ট্রাক্টর, স্ব-চালিত ট্রাক্টর থেকে রোবটিক কর্মী, এমন অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী কাজে লাগানো হচ্ছে। কৃষি রোবট সাধারণত রোবটিক অঙ্গের সাহায্যে বিশেষ ম্যানিপুলেটর, গ্রিপার এবং ইফেক্টরের মাধ্যমে কৃষকের ধীর, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং নিস্তেজ কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে পারে। যার ফলে কৃষক সামগ্রিক ফসল উৎপাদনে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে কৃষিতে সাধারণ কিছু রোবট যে সব কাজে ব্যবহার করা হয় তা হলো-ফসল তোলা এবং বাছাই করা, আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফসল ছাঁটাই, বীজ বপন, স্প্রে এবং পাতলা করা, ফেনোটাইপিং, বাছাই এবং প্যাকিং ইত্যাদি। কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক প্রায়শই বক্তব্যে খোরপোষের কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের কথা বলে থাকেন। ঈর্ষণীয় সাফল্যে বাংলাদেশের কৃষিও সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কথা উল্লেখ করা যায়। ধান গবেষণার কাজে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ করা হয়েছে বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সমৃদ্ধ করা হয়েছে গবেষণা ল্যাবরেটরি। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সব তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্রি কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সারাবিশ্বে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ডামাডোল। ১৮৩৭ সালে শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসী সমাজতান্ত্রিক লেখক জেরোমি ব্লাংকি। তবে এটি বিশেষ পরিচিতি লাভ করে ১৮৮১ সালের দিকে। তখন ইংরেজ বিখ্যাত ইতিহাস গবেষক আর্নল্ড জে. টয়েনবি অক্সফোর্ডে দেয়া তাঁর বক্তৃতায় এই কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন। মূলত প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল ১৭৮৪ সালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই শিল্প বিপ্লবে শ্রমভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে আমরা যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হই। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৭০ সালে বিদ্যুতের আবিষ্কার মানব সভ্যতায় নতুন মাত্রা সংযুক্ত করে। ২য় শিল্প বিপ্লবটি ছিল মূলত বিদ্যুতকে কেন্দ্র করে। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৯৬০ সালে তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভবের ফলে। ৩য় শিল্প বিপ্লবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার এবং অটোমেশন প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে সভ্যতা এগিয়ে যায় অনেকটা অকল্পনীয় গতিতে। এর মূল প্রভাবক ছিল কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন নামের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এটি মূলত আইসিটি নির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণাটি ১ এপ্রিল, ২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে কৃষি কিংবা কল-কারখানায় ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। আমূল পরিবর্তন আসে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লক চেইন প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, উন্নতমানের জিন প্র্রযুক্তি, বিগ ডেটা এ্যানালাইটিক, হরিজন্টাল ও ভার্টিক্যাল সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিক্স ইত্যাদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচিত প্রযুক্তি। কোভিড-১৯ অভিঘাত মোকাবেলা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উচ্চ প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের সামগ্রিক কৃষি গবেষণা কার্যক্রম এবং বাস্তবায়ন কার্যক্রম টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এর বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বস্তরে কৃষির সেরা অনুশীলনগুলোতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত করে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বর্ণিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এভাবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নয়ন, প্রয়োগ এবং অভিযোজনের মাধ্যমে বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে একটি নতুন যুগে। লেখক : উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি এ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১ [email protected]
×