ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় যৌনকর্মীকে খুন

প্রকাশিত: ১৯:২৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় যৌনকর্মীকে খুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভাসমান এক যৌনকর্মীকে আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান মোঃ খোকন ভুঁইয়া (২৮) নামের এক যুবক। অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় ওই যৌনকর্মীকে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে যায় খোকন। এরপর নিজের মোবাইল বন্ধ করে আত্মগোপন করেন। তার ধারণা ছিল, কোনোভাবেই তাকে শনাক্ত করতে পারবে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তিনদিনের মাথায় রবিবার খুনি খোকনকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পেশায় শেফ গ্রেফতারকৃত খোকন সোমবার বিকেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মঙ্গলবার ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শাহাদত হোসেন সুমা এসব তথ্য জানান। এডিসি শাহাদত হোসেন জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীর দুই নম্বর সড়কের রাজ ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক হোটেল থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবির পক্ষ থেকে ছায়া তদন্ত করা হয়। ঘটনার তিন দিনের মাথায় খুনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যার মোটিভ ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করে দ্রুত এই মামলার চার্জশিট দিয়ে দেয়া হবে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে ওই যৌনকর্মী ফার্মগেটের উদ্দেশে বের হন। কথা ছিল সকালে তার স্বামী তাকে বাসায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু সকাল থেকেই যৌনকর্মীর মোবাইল বন্ধ ছিল। ফোন বন্ধ পেয়ে তার স্বামী সহযোগী যৌনকর্মীদের কাছে খোঁজ নেন। সারাদিন খোঁজ না পেয়ে বাসায় ফিরে যান তিনি। পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর আবারও ফার্মগেট গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আগের রাতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে এক তরুণীর লাশ রাখা আছে। পরে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে স্ত্রীর লাশ শনাক্তের পর নিজের বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা (নং ১৯) দায়ের করেন তিনি। ওই যৌনকর্মীর স্বামী জানান, এক বছর আগে বিয়ে হয় তাদের। তার স্ত্রীর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরে একটি সন্তান রয়েছে। পেশাদার যৌনকর্মী জেনেও তিনি বিয়ে করেছিলেন। তিনি তাকে ‘সুপথে’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকান্ডটি একটি ক্লু-লেস ঘটনা ছিল। কারণ হোটেল রেজিস্ট্রারেও অভিযুক্ত তরুণ নিজের অসম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগের নাম্বার দিয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তায় একটি বিশেষ সূত্রের মাধ্যমে খুনিকে শনাক্ত করা হয়। পরে হোটেলে থাকা সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর রবিবার সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা এলাকা থেকে খোকন নামে ওই তরুণকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারকৃত খোকন পুলিশকে জানায়, তার বাবার নাম আব্দুল বারেক ভুঁইয়া। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনার কৃষ্ণপুরে। দীর্ঘ দিন প্রবাসে ছিল সে। দেশে ফিরে দুই বছর আগে বিয়ে হয়। স্ত্রীকে নিয়ে বাড্ডার লিংক রোড এলাকায় থাকতো সে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ক্যাফে হুইলস-এ কারিগর হিসেবে কাজ করতো খোকন। খোকনের দাবি, ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে ক্যাফের কাজ শেষে বের হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে একটি বারে যায় সে। সেখানে একটি বিয়ার পান করে সে। তারপর আড্ডা দিয়ে রাত ১টার দিকে আবারও ক্যাফেতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু এত রাতে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশের জন্য চেকপোস্টে তাকে আটকায়। ভেতরের কাউকে দিয়ে ফোনে কথা বলিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করতে বলে চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা সেনা সদস্যরা। এত রাতে ক্যাফের পরিচালনায় জড়িত কর্মকর্তাদের ফোন না করে সে একটি সিএনজিযোগে চলে যায় ফার্মগেট এলাকায়। গ্রেফতারকৃত খোকন জানায়, মধ্যরাতে ফার্মগেটে ওভারব্রিজের ওপর তার সঙ্গে দেখা হয় ভাসমান ওই যৌনকর্মীর। তিন হাজার টাকায় এক রাতের জন্য চুক্তি হয়। পরে ওই যৌনকর্মী তাকে নিয়ে যায় শ্যামলীর দুই নম্বর সড়কের হোটেল রাজ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। জিজ্ঞাসাবাদে খোকন জানায়, হোটেলে ঢোকার আগেই ওই যৌনকর্মী তার কাছ থেকে চুক্তির তিন হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পরে ভোরের দিকে ওই যৌনকর্মী তাকে ব্ল্যাকমেইল করে। অতিক্তির বিশ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে লোকজনের মাধ্যমে সম্মানহানির ভয় দেখায়। এতে সম্মান বাঁচাতে ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েটির গলা টিপে ধরে খোকন। আরেক হাত দিয়ে মেয়েটির দুই হাত বাঁধে খাটের সঙ্গে। চিৎকার করায় তরুণীর ওড়না দিয়ে তার মুখ বেঁধে রাখে। তারপর হোটেল কক্ষের দরজা বন্ধ করে পালিয়ে যায় সে। তার ধারণা ছিল, হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর হোটেলকর্মীরা মেয়েটিকে উদ্ধার করবে। সে কল্পনাও করেনি মেয়েটি মারা যাবে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সে মেয়েটির মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পারে। গ্রেফতারের পর থেকেই মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের কান্নাকাটি করছিল খোকন। পরিবারের কাছে নিজের সম্মান বাঁচাতে একটি ভুল করে ফেলেছে বলে অনুশোচনা করছিলেন বারবার। এ সময় গ্রেফতারকৃত খোকন জানায়, একটা ভুল তার জীবনটা শেষ করে দিলো। বারবার নিজের স্ত্রীর প্রশংসাও করছিল সে। বলছিল, তার স্ত্রী তাকে খুব ভালোবাসে। তাদের সুখের সংসার। কিন্তু মাথায় কী একটা ভুত চেপেছিল যে, মধ্যরাতে বাসায় না গিয়ে ফার্মগেট থেকে যৌনকর্মীকে নিয়ে হোটেলে যায়। এরপর কিভাবে কি হয়ে গেলে বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভাসমান যৌনকর্মীদের কেউ কেউ খদ্দের সঙ্গে সময় কাটাবার পর অতিরিক্ত অর্থের জন্য ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে এরকম অভিযোগও তারা পেয়েছেন। তাই বলে কোনওভাবেই আইন নিজের হাতে না তুলে নেয়া যাবে না। একপর্যায়ে হত্যায় জড়িত খোকনকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, খোকন এক সময় মধ্যপ্রাচ্য শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দেশে ফিরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। ৭ সেপ্টেম্বর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে দুজনে বিয়ার পান করেন। এরপর চলে আসেন ফার্মগেট এলাকায়। রাত ২টার দিকে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের ওপর আসমা ওরফে লিমা বেগম ওরফে কবিতা (২৫) নামের এক নারীর সঙ্গে তার কথা হয়। কবিতা তার সঙ্গে রাত কাটাতে সম্মত হলে দুজনে চলে যান শ্যামলীর দুই নম্বর সড়কের ৪/১ নম্বর ভবনে রাজ ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক হোটেলে। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে হোটেলটির ছয়তলার ৬০২ নম্বর কক্ষে ওঠেন। পরদিন ওই কক্ষেই খাটের সঙ্গে ওড়না দিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় কবিতার মরদেহ পাওয়া যায়।
×