ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় চারদিকে মৃত্যুর কোলাহল একদিনে রেকর্ড মৃত্যু ২৬৪

বেপরোয়া মানুষ

প্রকাশিত: ২২:৪০, ৬ আগস্ট ২০২১

বেপরোয়া মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে একদিনে করোনায় রেকর্ড সংখ্যক ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঈদ-উল-আজহার আগে কঠোর বিধিনিষেধের শিথিলতার সুযোগে গাদাগাদি করে চলাচল করায় সংক্রমণ বেড়েছে। ডেল্টা ধরনের কারণে আগের তুলনায় গুরুতর রোগীর সংখ্যা বাড়ায় মৃত্যু বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা ও উপসর্গ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে চিকিৎসার আওতায় না আসাও বর্তমানে মৃত্যুর হার বাড়ার নেপথ্যে কাজ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত) করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এক দিনে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে করোনায় দেশে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৯০২ জনে। এর আগে ২৭ জুলাই ২৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৭৪৪ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৩ লাখ ২২ হাজার ৬৫৪ জনে। এর আগে বুধবার ২৪১, মঙ্গলবার ২৩৫, সোমবার ২৪৬, রবিবার ২৩১, শনিবার ২১৮ ও শুক্রবার ২১২ জনের মৃত্যু হয়। গত ৭ জুলাই প্রথমবারের মতো দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়ায়। এদিন মৃত্যু হয় ২০১ জনের। এরপর থেকে দু-একদিন ছাড়া অধিকাংশ দিন করোনায় ২ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে করোনা রোগীদের ৯৮ ভাগই ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত। এই ধরনের আক্রান্ত রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির দ্রুতই অবনতি ঘটে থাকে। ফলে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ডেল্টা ধরনে আক্রান্তদের ফুসফুসের ৭০ শতাংশ দ্রুতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট বেশি লাগছে। কিন্তু সারাদেশে কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মূলত আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে না পারার কারণেও মৃত্যু বাড়ছে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই করোনায় দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। এমন দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটেছে, যেদিন করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধের নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই প্রজ্ঞাপনে আগামী ১১ তারিখের পর সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু, অফিস আদালত ও কলকারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সামান্য সুযোগ পেয়ে যখন মানুষ ঈদ করতে রাজধানীর বাইরে চলে গেছে, সেখানে আগামীতে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল হলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি কেমন মানে সেটিই দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে লকডাউন দেখার নাম করে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। অনেককে জরিমানা ও জেলও খাটতে হয়েছে তুচ্ছ কারণে। কিন্তু তাতেও স্বাস্থ্যবিধি মানেননি তারা। উল্টো স্বাস্থ্যবিধি ভাঙ্গার প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। তারা নিজেদের পরিবার পরিজনদের কথাও মাথায় আনেনি। করোনা প্রতিরোধে শুরু থেকে টিকাকরণে পিছিয়ে থাকার কারণে সরকার বিধিনিষেধ পালন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু দেশের জনগণ সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। তারা নিজেদের সংক্রমিত করেছে, আর সংক্রমণ ছড়িয়েছে অন্যদের মাঝে। সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শুধু মানুষের উদাসীনতার খেসারত হিসেবে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। তাতেও হুঁশ ফিরছে না। এখনও রাজধানীসহ সারাদেশে মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা যায়নি। মানুষকে সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য করা যায়নি। তাই আগামীতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। হেলথ এ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, ডেল্টা ধরনের কারণে নানা বয়সের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। আলফা-বিটা ধরনের কারণে বেশি বয়স্করা মৃত্যুঝুঁকিতে ছিলেন। কিন্তু এবার সব বয়সী মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুঝুঁকিতে অল্প বয়সীরাও রয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী নারীরা এবার করোনায় ঝুঁকিতে রয়েছেন। ডেল্টা ধরন আলফা-বিটার চাইতে বেশি সংক্রামক হওয়ার কারণে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেড়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডাঃ মুসতাক হোসেন বলেন, ঈদ-উল-আজহার আগে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের কারণে বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেড়েছে। গার্মেন্টস খোলার খবরে রাজধানীতে ঢলের মতো মানুষ আসার কারণে আগস্টের মাঝামাঝি প্রভাব পড়বে। তখন মৃত্যুহার আরও বাড়তে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১৫ হাজার ৭৮৬ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৫২২ জনের। পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৯৫টি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৮টি। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বিভাগ ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের আছেন ৮৭ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ৫৬, রাজশাহীতে ১৯, খুলনায় ৩৫, বরিশালে ১৬, সিলেটে ২৩, রংপুরে ১৮ এবং ময়মনসিংহে ১০ জন মারা গেছেন। নারী-পুরুষ হিসেবে দেখা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৪০ জন পুরুষ এবং ১২৪ জন নারী। এদের মধ্যে ১৯ জন বাসায় মারা গেছেন। বাকিরা হাসপাতালে মারা গেছেন। এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে মোট মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ১৪ হাজার ৬৮৪ জন এবং নারী ৭ হাজার ২১৮ জন। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৪২ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ৫৯, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৩১, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ২৫, ২১ থেকে ৩০ বছরের ৫, ১১ থেকে ২০ বছরের ১ ও ১০ বছরের কম বয়সী ১ জন মারা গেছেন। বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। দেশে করোনার ডেল্টা ধরনের দাপটে দৈনিক সংক্রমণ এবং করোনায় মৃত্যু কয়েক গুণ বেড়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ দেশে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ পালন করা হয়। এ সময় সব ধরনের অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়। ২১ জুলাই ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে এই বিধিনিষেধ আট দিনের জন্য শিথিল করা হয়। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হয়। এর মধ্যেই গত রবিবার রফতানিমুখী শিল্প কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার কঠোর বিধিনিষেধ আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এরপরে সীমিত আকারে গণপরিবহনসহ অফিস আদালত খুলে দেয়া হবে।
×