ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, গড়ে উঠছে দালানও

প্রকাশিত: ২২:০৭, ৩ আগস্ট ২০২১

চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, গড়ে উঠছে দালানও

নয়ন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বর্ষাকে সামনে রেখে চট্টগ্রামে প্রতিবছরই চলে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ। সরানো হয় বসবাসকারীদের। কিন্তু ঘুরেফিরে তারা আবারও সেই পাহাড়েই আশ্রয় নেয়। এর প্রধান কারণ অল্প ভাড়ায় বসবাসের সুবিধা। মৃত্যুভয় তুচ্ছ এই বসতকারীদের কাছে। শুধু কাঁচাঘরই নয়, গড়ে উঠছে দালান ও বিভিন্ন স্থাপনা। গ্যাস, বিদ্যুত, পানিসহ সকল ধরনের সরকারী সেবা পাওয়ায় সেখানে বসবাস করছে লোকজন। রিট মামলা এবং সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিচ্ছে ঘর নির্মাণকারীরা। পাহাড়গুলোতে এক যুগের বেশি সময়ের চেষ্টায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা যায়নি। অবৈধ বসতি সরাতে সারা বছর প্রশাসনের কোন উদ্যোগ না থাকলেও বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদে তোড়জোড়। রাজনৈতিক ভোট ব্যাংক এবং বিভিন্ন পাহাড়ের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটসহ নানা জটিলতায় সরানো যাচ্ছে না বসতি। পাহাড়ে বিদ্যুত গ্যাস ওয়াসার সংযোগ থাকায় তাদের উচ্ছেদ করলেও সেবা সংস্থাগুলোর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের সুযোগটা নিচ্ছে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা। তথ্যমতে, জেলায় সরকারী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে ৮৩৫টি পরিবারের মানুষ। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১। সরকারী বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ৭টি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবার আছে ৩০৪টি। অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসন তৎপর হয় ভারি বর্ষণ শুরু হওয়ার পর। নগরীর লালখান বাজার এলাকার মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, বাটালি হিল, গরীবুল্লাহ শাহ হাউজিং, চন্দ্রনগরে হাজার হাজার বসতি আছে। এই বর্ষায়ও বিভিন্ন কৌশলে পাহাড় কেটে বসতি গড়েছে নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালীরা। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে তিন-চারতলার দালান। সীতাকুন্ডের জঙ্গল সলিমপুরে অধিকাংশ পাহাড় কেটে স্থাপনা করে বসতি করা হয়েছে। মূলত ২০০৪ সাল থেকে পোশাক শ্রমিক ও নিম্নআয়ের লোকজন মৃত্যুভয়কে আলিঙ্গন করে কয়েক যুগ ধরে বসবাস করছে পাহাড়ে। গত সপ্তাহে নগরীর চার স্থানে পাহাড়ধস হয়, তবে কোন প্রাণহানি হয়নি। সূত্রমতে, পাহাড়ে বসতি গড়ার পেছনে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট নেতারা জড়িত বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বসতকারীদের ভোটব্যাংক হিসেব ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিরা। তাই তারা উচ্ছেদে অনীহা দেখায়। অসহায় লোকজনদের পাহাড়ে বাসা ভাড়া দিয়ে বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি করছে। সরকারী সেবা সংস্থাগুলোর সংযোগ থাকায় পাহাড়ে বসতির আগ্রহ থামছে না। প্রতিবছরই উচ্ছেদ অভিযানে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কিছুদিন পর লোকজন আবারও ফিরে যায় পুরনো আবাসস্থলে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ কম ভাড়ায় থাকার জন্য মৃত্যুঝুঁকি জেনেও সেখানে বসবাস করছে। ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে একদিনেই মৃত্যু হয় ১২৭ জনের। গত ১৫ বছরে ২৩০ জনের অধিক পাহাড় ধসে মারা গেছে। পাহাড়ধসে মৃত্যু ঠেকাতে রয়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। গত মে মাসে কমিটির ২১তম সভায় সেবা সংস্থাসমূহকে পাহাড়ের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রতিনিধির নাম প্রস্তাবনা চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও কার্যত দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব অবহেলার কারণে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকানো যাচ্ছে না জানিয়ে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নূরুল্লাহ নূরী জনকণ্ঠকে বলেন, রেজুলেশন করে বিদ্যুত বিভাগকে গত মাসে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বলা হলেও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ তারা নেয়নি। এই পর্যন্ত পাহাড়ে যেসব অভিযান করেছি সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ সচল দেখা গেছে। গ্যাস পানির বিদ্যুত সংযোগ যতদিন থাকবে উচ্ছেদ সফল হবে না। তিনি আরও বলেন, পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করে জরিমানা করা হয়। আমরা অভিযান করি এক হিসেবে গায়ের জোরে, কিন্তু যাদের দায়িত্ব পাহাড়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার তারা সব সময় নিশ্চুপ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দফায় দফায় উচ্ছেদ চলছে। সেখানে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে এনে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। তবে প্রশাসন চলে আসার পর ফের পাহাড়ে ফিরে বসতকারীরা। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, পাহাড়ে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ নেই। তবে কয়েকটি পাহাড়ের বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট আছে, সে কারণে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিতরণ দক্ষিণাঞ্চল চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী সামিনা বানু বলেন, বসতি স্থাপনের পূর্বে যেসব সরকারী সংস্থার অনুমতির প্রয়োজন তাদের দোষ বেশি। এরপর আসে বিদ্যুতের সংযোগ। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ (চসিক) এ ধরনের সংস্থাগুলো যদি আগেভাগে তৎপর হতো তাহলে বিদ্যুত সংযোগ সেখানে পৌঁছাতো না। যেসব পাহাড়ে অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ আছে, তা অবশ্যই বিচ্ছিন্ন করা হবে।
×