ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্রাবণে শুধু বরিষণ নয়

সমুদ্র মন্থনের মাস- নানা শ্রুতি, পৌরাণিক আচার

প্রকাশিত: ২২:০২, ৩ আগস্ট ২০২১

সমুদ্র মন্থনের মাস- নানা শ্রুতি, পৌরাণিক আচার

মোরসালিন মিজান ॥ শ্রাবণজুড়েই বৃষ্টি। অবিরাম বর্ষণ। এ বর্ষণে অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে, লক্ষ্য করেছেন? এখনই কান পাতুন। যাই যাই করছে মাসটি। তার আগে শুনে নিন শ্রাবণের গান। দারুণ ছন্দে মিয়া তানসেনের তানপুরাটাই যেন বেজে চলেছে! বাঙালীর সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে অনবরত বাজছে বৃষ্টির সুর। ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়। ফলে বৃষ্টি হয় প্রচুর। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে নতুন প্রাণ পায় প্রকৃতি পরিবেশ। আর এ পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে শ্রাবণ। শ্রাবণের যে রিমঝিম, তার আলাদা মাধুর্য। অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ কাজ করে এ সময়। আপ্লুত না হয়ে পারা যায় না। কবিকুলের ওপর শ্রাবণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অজস্র কবিতায় গানে শ্রাবণ এসেছে, কতভাবে যে এসেছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। শুধু কি তাই? যার শুকনো কলমে মোটেই লেখা আসেনি, আসে না, তিনিও মনের দু’এক কথা সঠিক ছন্দে লিখে দিয়েছেন। তবে শ্রাবণে শুধু বারিধারা নয়। মাসটি ঘিরে আছে নানা শ্রুতি। সনাতন কিছু বিশ্বাসের কথা শোনা যায়। পালিত হয় পৌরাণিক নানা আচার। বলা হয়ে থাকে, শ্রাবণ সত্য শুভ সুন্দর কথা শ্রবণের মাস। হ্যাঁ, ‘শ্রবণ’ থেকেই ‘শ্রাবণ।’ এ মাসে তাই সত্যটা শুনুন। আর বাকি সময়? মিথ্যা রটনা গুজব কানে তোলা যাবে? না, তা নয়। সব সময়ই সত্যানুসন্ধান করতে হবে। তবে শ্রাবণের কাছে প্রত্যাশা একটু বেশি। শ্রাবণ সত্য শ্রবণের মাস। পৌরাণিক কাহিনীতেও আছে শ্রাবণ। সমুদ্র মন্থনের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। পুরাণ অনুসারে, ব্যাপক আলোচিত সমুদ্র মন্থনের ঘটনাটি শ্রাবণ মাসেই ঘটেছিল। সমুদ্র মন্থনে ভয়ঙ্কর এক বিষ উত্থিত হয়। হলাহল নামক বিষে গোটা বিশ্ব জর্জরিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় সমস্ত সৃষ্টি রক্ষার কঠিন শপথে মহাদেব শিব ওই বিষ পান করেন বলে শ্রুতি রয়েছে। প্রচন্ড সেই বিষকে স্বকণ্ঠে ধারণ করেন তিনি। সেই থেকে নীলকণ্ঠ। আজ যে কথায় কথায় ‘নীলকণ্ঠ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেটি সম্ভবত শ্রাবণেই পাওয়া হয়েছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শ্রাবণ মাসটিকে শিবের মাস হিসেবেও গণ্য করেন। এই মাসের প্রতি সোমবার শিবের ব্রত পালন করেন অনেকে। ব্রত পালনের মাধ্যমে মনস্কামনা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করেন তারা। একই বাসনা থেকে মেয়েরা হাতে সবুজ চুড়ি পরেন। শ্রাবণ মাসে বৃক্ষরোপণের কথাও বলা আছে শাস্ত্রে। বর্ষাজুড়েই গাছ লাগানো যায়। তবে শাস্ত্রে পাঁচটি গাছের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি খুব চেনা গাছ- অশ্বত্থ। উহু, বাড়িতে নয়। শ্রাবণের বর্ষণ সিক্ত উদ্যানে, রাস্তার ধারে অশ্বত্থ গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ কারণেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণে, অশ্বত্থ কিন্তু বাড়িতে কেউ লাগান না। বাইরে খোলা জায়গায় এ বৃক্ষকে ডালপালা সমেত বাড়তে দেখা যায়। বৃহস্পতিবার অশ্বত্থ গাছ লাগানোকে শুভ জ্ঞান করা হয়। উল্লেখ আছে তুলসি গাছের কথাও। তুলসি গাছ রোপণ করলে বৈবাহিক জীবনে সুখ, সংসারে সমৃদ্ধি আসে বলে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ। বৈবাহিক অশান্তি দূর করতে কলাগাছ লাগানোর কথাও বলা হয়ে থাকে। মাসের একাদশী বা বৃহস্পতিবারে ঘরের পিছনে কলা গাছ লাগানো ভাল। তবে বাড়ির সামনে কলা গাছ লাগাতে বারণ করা আছে। কেন? কে বলবে! কল্যাণের পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে এসে শ্রাবণ মাসটির সঙ্গে যোগ হয়েছে ভয়ঙ্কর এক ট্র্যাজেডিও। সাম্প্রতিক বলতে, ৪৬ বছরের আগের কথা। ১৩৮২ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ শ্রাবণ নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সপরিবারে তাকে হত্যা করা হয়। শ্রাবণের এ ট্র্যাজেডি পুরাণের কোন গল্প নয়। বাস্তবেই ঘটেছিল। ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিলো, ছিলো না চাঁদ/ভোরের আকাশে সূর্যের আলো থেকে তোমার রক্ত/মিশে গেল সমুদ্র সমতল...।’ মাসটি এভাবে শোকের আবহ ছড়িয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় অন্তর্দহন। কবিগুরুর ভাষায় বললে: ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে...।’ আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার বেদনার কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘কাঁদিবে সে সারা রাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছ চিতা।’ এভাবে বাস্তব জীবনের সুখানুভূতি গভীর শোক এবং পৌরাণিক গল্পগাঁথাকে সযতেœ লালন করে চলেছে শ্রাবণ। শ্রাবণকে তাই উপেক্ষা করা যায় না। তার আমন্ত্রণে সারা দিতে হয়। যুগ যুগ ধরে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে বাঙালী।
×