ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর মোঃ হামিদুল হক

অতিমারীতে অতিকথন

প্রকাশিত: ২০:২৮, ২ আগস্ট ২০২১

অতিমারীতে অতিকথন

(গতকালের পর) ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সকল মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ের তত্ত¡াবধানে ইউনিয়ন বা গ্রামভিত্তিক মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সভা করে তাদের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। মসজিদ কমিটির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সর্বসাধারণের মাঝে সুরক্ষা সামগ্রী ও প্রচারপত্র বিতরণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ের প্রধান ও কমিটিগুলোর মাধ্যমে অনুরূপ কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে। টিকা গ্রহণ সম্পর্কে মানুষের কুসংস্কার, বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার রোধে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা রাখা অত্যন্ত জরুরী। শিক্ষকদের দিয়ে টিচার্স ব্রিগেড গঠন মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে দেশের সকল কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা ও প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসারদের একটি সুবিন্যস্ত কাঠামো রয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। দেশের এ দুর্যোগকালীন অবস্থায় শিক্ষকগণ ঘরে বসেই প্রতিটি মানুষকে মোবাইল ফোনে অথবা নিজ পাড়া-মহল্লার প্রতিবেশীদের দূরত্ব বজায় রেখেই সচেতন করতে পারেন। একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরভাবে শিক্ষকদের এ সময়ে সামাজিক সচেতনতার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এক্ষত্রে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো শিক্ষকদের মোবাইল ফোনে প্রয়োজনীয় ডেটা বা রিচার্জের ব্যবস্থা করতে পারেন। এটুআই কর্মসূচী যেমন ড্যাসবোর্ডের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস মনিটরিং করেছিল, একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের সচেতনতামূলক কার্যক্রমকেও কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা যেতে পারে। হেলথ ক্লাব গঠন কোভিড মহামারীতে সর্বসাধারণের স্বাস্থ্য সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য সকল মানুষের বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। বিশেষত যে সকল কার্যক্রমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় সে সকল ব্যায়াম, ফুসফুসের সক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল, পুষ্টিকর ও সমন্বিত খাবার গ্রহণ, পরিমিত বিশ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে পাড়া-মহল্লায় হেলথ ক্লাব গঠন করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শরীরচর্চা শিক্ষকের নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তত্ত¡াবধানে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের প্রশাসন বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ এ কার্যক্রমগুলো তত্ত¡াবধান ও আর্থিক সহায়তা করতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবী ও এনজিও সংগঠনগুলোর সমন্বয় সাধন বাংলাদেশে গ্রাম, পাড়া, মহল্লাভিত্তিক অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। স্থানীয় তরুণরাই এ সকল সংগঠনের সদস্য। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা সাধারণত সমাজসেবায় আগ্রহী হয়ে থাকে। বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এ সকল তরুণ এখন অনেকটাই গৃহবন্দী। এদের সামাজিক সংযোগ চমৎকার। তাছাড়া এ সকল তরুণরা কর্মঠ, দেশপ্রেমিক, স্বেচ্ছাশ্রমে আগ্রহী হয়ে থাকে। এ বিপুল পরিমাণ তরুণ জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করে সমন্বিতভাবে একটি কাঠামোর আওতায় আনতে পারলে সামাজিক সংক্রমণরোধে একটি বৈপ্লবিক অগ্রগতি হতে পারে। বাংলাদেশে বিদ্যমান এনজিওগুলোর গ্রামপর্যায় পর্যন্ত একটি শক্তিশালী কাঠামো বিদ্যমান। এনজিও সংগঠনগুলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্কের আওতায় এনে মহামারী নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক ব্রিগেড গঠন আমাদের দেশের ইতিহাসে দেখা যায় যে কোন দুর্যোগে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মীরা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জাতীয় এ দুর্যোগে শিল্পকলা একাডেমির নেতৃত্বে জেলা উপজেলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সাংস্কৃতিক ব্রিগেড গঠন করা যেতে পারে। দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা অতিমারীর এ দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের খাদ্য সঙ্কট দূরীকরণ একটি অত্যন্ত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এটা সত্য ক্ষুধার্ত মানুষকে ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটাও সত্য কোভিড মোকাবেলা করতে মানুষকে অবশ্যই ঘরে রাখতেই হবে। এ দুঃসময়ে এ দুটোর সমন্বয় সাধন করতে পারে কমিউনিটি ইনভলভমেন্ট বা সামাজিক অংশগ্রহণ। একটি পাড়ায় বা মহল্লায় কে কে অভুক্ত আছেন বা কার ঘরে খাবার দরকার তা ঐ পাড়া বা মহল্লার সামাজিক নেতারাই জানেন। পাড়ার যে কজন সচ্ছল ব্যক্তি আছেন তারা সবাই মিলে স্বেচ্ছা ভিত্তিতে পালাক্রমে ঐ দরিদ্র মানুষদের পর্যায়ক্রমিকভাবে চাল ডালের ব্যবস্থা করতে পারেন। এছাড়াও স্থানীয় সরকারের নেতৃবৃন্দ বা সরকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ঐ দরিদ্র মানুষটির তথ্য প্রদান করে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করতে পারেন। কোভিড আক্রান্তদের পাশে থাকা কোভিড ভাইরাস প্রতিরোধে কোভিড শনাক্তকরণ ও আইসোলেশন অত্যন্ত জরুরী। এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে না উঠলে এ মহামারীতে সংক্রমণ রোধ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। পাড়ায় মহল্লায় যে কমিটি গঠিত হবে তারা এ বিষয়ে আন্তরিক থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন দেশের প্রায় সব উপজেলায় কোভিড পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই সন্দেহজনক ব্যক্তি যেন দ্রæত পরীক্ষার আওতায় আসেন সে বিষয়ে সর্বসাধারণকে সচেতন করতে হবে। চিকিৎসায় বিলম্ব হলে রোগী বিপদাপন্ন হতে পারেন এ বার্তা টিচার্স ব্রিগেড বা স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কেউ কোভিড আক্রান্ত হলে তিনি যেন সামাজিক বিড়ম্বনার শিকার না হন সেদিকে নজর দিতে হবে। পাড়া-মহল্লায় গঠিত কমিটির সদস্যরা আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তার চিকিৎসা, ওষুধ, খাবার, অক্সিজেন সরবরাহ এবং প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। টিকা গ্রহণে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ কোভিডের এ মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণের একটা শক্তিশালী অস্ত্র টিকা। প্রধানমন্ত্রীর বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় এখন দেশে মোটামুটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকার মজুত রয়েছে। পাইপলাইনে অপেক্ষা করছে আরও অনেক টিকার চালান। যত দ্রæত অধিক সংখ্যক মানুষ টিকার আওতায় আসবেন তত দ্রæতই সবার জন্য কল্যাণ হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, টিকা কেন্দ্রগুলোতে এখন কাক্সিক্ষত মাত্রায় লোক সমাগম নেই। ঢাকা শহরসহ জেলা উপজেলায় টিকা কেন্দ্রগুলোর চিত্র সন্তোষজনক নয়। সরকার ইতোমধ্যে টিকা দান কার্যক্রম ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছে। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটি সাধারণের কাছে সুগম্য না হওয়ায় এখন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেই টিকা নেয়া যাবে। বয়সসীমাও ১৮ বছরে নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষকে রেজিস্ট্রেশন করতে উৎসাহিত করা প্রতিটি সচেতন মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো আওতাধীন এলাকার জনগোষ্ঠীর ডেটাবেজ তৈরি করে কোন্্ এলাকায় কে টিকা নেননি, তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করবে। কোভিড মহামারীতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কমিটির প্রস্তাবিত কাঠামো হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন ‘জীবন খুবই মূল্যবান: জীবনবাদীরা যতটা মূল্যবান মনে করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।’ তাই মহামূল্যবান জীবনকে বাঁচাতে জেগে উঠতে হবে মানুষকেই। বাংলাদেশের জনগণকে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এ সময়ে সবচেয়ে বড় দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন। কারণ এ শত্রæকে দেখা যায় না, উপলব্ধিও করা যায় না। একে প্রতিহত করার একমাত্র অস্ত্রই হচ্ছে সামাজিক সচেতনতা। বাঙালী জাতি জেগে উঠলে অনেক বড় দুর্যোগ ও শত্রæকে মোকাবেলা করে পরাভূত করতে পারে এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে। এ অদৃশ্য শত্রæকেও বাংলাদেশের মানুষ তাদের সচেতনতার অমোঘ অস্ত্র দিয়ে একদিন অবশ্যই পরাভূত করবে। এখন যত দ্রæত মানুষকে সচেতন করা যাবে আমাদের প্রাণহানি ও বিড়ম্বনা ততই কম হবে। (সমাপ্ত) লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন ও সাবেক মহাপরিচালক জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)
×