ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহদাব আকবর

রক্তঝরা আগস্ট ইতিহাস এবং পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১ আগস্ট ২০২১

রক্তঝরা আগস্ট ইতিহাস এবং পর্যালোচনা

প্রতি বছর আমাদের জীবনে ঘুরে আসে শোকাবহ আগস্ট মাস। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আজও শুনতে পাই ’৭১-এর রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত ৭ কোটি বাঙালীকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো ‘বঙ্গবন্ধু’কে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই আগস্ট মাসে। ১৫ আগস্টে আরও হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেককে ও জাতির পিতার ডাকে তাকে রক্ষা করতে ঐ রাতে এগিয়ে আসা কর্নেল জামিলসহ নাম না জানা শহীদদের। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনকারীরা সেদিন প্রতিশোধ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ষড়যন্ত্রকারীরা ’৭১-এর কুলাঙ্গার আলবদর-রাজাকার, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতক ও পথভ্রষ্ট বিপথগামী বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষ শক্তি একাট্টা হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে ছিল বিভোর। স্বাধীনতার পর ’৭২ সাল থেকেই মূলত ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম কাজ ছিল স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির মধ্যে অটুট বন্ধনে ভাঙ্গন ধরানো। এবার সেই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া শুরু হয় ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় জাসদ নামের সংগঠন। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেদিন সারা দেশ থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, ’৬৯-৭০-এর আন্দোলন ও ’৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের অসীম অবদান ছিল তাদের অনেকে সেদিন জাসদে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে জাসদেরই ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন ‘গণবাহিনী’ দ্বারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও, সমগ্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা, থানা লুণ্ঠনসহ একের পর এক কার্যক্রম চলতে থাকে। সে সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটিমেরে থাকা অশুভ শক্তি যাদের নেতৃত্বে পঁচাত্তর পরবর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল তাদেরই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ’৭৪ সালে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যহতি নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনিসহ চার জাতীয় নেতা কারা অভ্যন্তরে পঁচাত্তরের ৩ নবেম্বর খুনী মোশতাক-ডালিমদের বুলেটে বুকের পাঁজর ছিন্নভিন্ন হয়ে শেষ রক্তবিন্দু থাকতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণ করে গেছেন। শোকের মাসে তাদেরকেও স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। একদিকে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির মধ্যে বিভাজন ও সংঘর্ষ, অন্যদিকে পরাশক্তি দ্বারা সৃষ্ট ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এমনি এক পরিবেশে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের মূল লক্ষ্য জাতির জনককে হত্যা করার মিশন সফল করতে। শুধু জাতির জনকের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনই নন, ৩ নবেম্বর চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর ক্যু, কাউন্টার ক্যুয়ের মধ্য দিয়ে একে একে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা নিধন অভিযান। ৭ নবেম্বর জাসদের নেতৃত্বে ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’-এর নামে কাউন্টার ক্যু হলে ৩ নবেম্বর ক্ষমতায় আসা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ নিহত হন। পরবর্তীতে জাসদ নেতারা ৪ দিন অন্তরীণে থাকা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করলে তিনি একক ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য যারা তাকে মুক্ত করেছিল তাদের প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে হত্যা করে। এমনকি ৭৭ সালে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই হয়ে যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে তখন বিমানবাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসার এয়ারপোর্টে অবস্থান করছিলেন ছিনতাই নাটকের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে। ঠিক সেই সময় বিমানবাহিনীকে দুর্বল করার নিমিত্তে বিমানবন্দরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বহু বিমানবাহিনীর সিনিয়র অফিসার নিহত হন। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালীন সেনাবাহিনীতে ২৪/২৫ বার ক্যু’র প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং সেনাবাহিনীর বহু সদস্য প্রাণ হারান। ঐ সময় একে একে গোলাম আযমসহ দেশে ও দেশের বাইরে পালিয়ে থাকা প্রায় সকল যুদ্ধাপরাধী আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। রাজাকার শাহ আজিজ হন প্রধানমন্ত্রী। সে সময়ই স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের মতবাদ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ সময় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও দলছুট নৈতিকতা বিবর্জিত তথাকথিত নেতারা ’৭৫ পরবর্তী সময় ক্ষমতা থাকাকালে মুছে দিতে চেয়েছিল স্বাধীনতার ইতিহাস। রাজনীতিবিদ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি পরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যার প্রভাব থেকে আজও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তি বারবার আগস্ট মাসেই তাদের অপতৎপরতা চালিয়েছে। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে জনসভায় দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বক্তব্যরত অবস্থায় হত্যা করার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মানবঢাল হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাখায় অলৌকিকভাবে তিনি রক্ষা পান। তবে সেদিনের হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও বহু নেতাকর্মী আহত হন। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের স্পিøন্টার শরীরে নিয়ে আজও অনেক নেতাকর্মী দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। এরপর ২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একই সঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা ঘটানো হয়। এর আগে ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা উদ্ধার করা হয়। ২২ জুলাই শেখ লুৎফর রহমান কলেজমাঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা হওয়ার কথা ছিল। এভাবে একাধিকবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেও অপশক্তিরা সফল হতে পারেনি। ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা করার পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতা সেদিন মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন। অনেকে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জেলখানায় বসে থাকাটাই নিরাপদ মনে করেছিলেন। এমন একটা ভয়াবহ সময় ছিল যা এখন কল্পনারও অতীত। একমাত্র টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঘোষণা আসত- সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, আকারে কিংবা ইঙ্গিতেও রাজনৈতিক কার্যকলাপ দ-যোগ্য অপরাধ। এমনি একটা সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত আমার মরহুম পিতা গোলাম আকবর চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের প্ল্যানিং সেলের অবৈতনিক সদস্য ও মাতা বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে একে একে অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ শুরু করেন। সে সময় আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম আমাদের বাসা ইন্দিরা রোড রাজাবাজারে অবস্থিত ‘মরিচা হাউস’ থেকে পরিচালিত হতো। আমার বাবা ও মা যাদের মাধ্যমে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওমর আলী, জনাব ভুইয়া, মরহুম আক্তার হোসেন, মরহুম ফজলুল হক রাজু ও শ্রমিক লীগের হাবিবুর রহমান সিরাজ। বাবা-মা’র যৌথ প্রয়াশে একে একে নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়া হয় তখন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ ও ভারপ্র্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা হয়েছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সে সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন খুলনার মরহুম সালাউদ্দিন ইউসুফ। ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়ার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সই-এ আওয়ামী লীগ নামে একটি সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা হয় ঐতিহাসিক ‘মরিচা হাউস’-এর ঠিকানা থেকে ১৯৭৬ সালের ৮ অক্টোবর। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই মরিচা হাউসেই ১৯৭০ সালে মহিলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হতো। এই বাড়ির বিশাল মাঠে বঙ্গবন্ধু জনসভাও করেছেন। ৪ নবেম্বর ১৯৭৬-এ তৎকালীন সরকার আওয়ামী লীগ নামে সংগঠন করার অনুমতি দেয়। অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণোদ্যমে সাংগঠনিক কার্যকলাপ শুরু করতেই জিয়াউর রহমান সরকার ভীত হয়ে সাজেদা চৌধুরীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দীর্ঘ এক বছর কারাভোগের পর সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করলে হাইকোর্ট থেকে তাকে মুক্তির আদেশ দেয়া হয়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগকে দলের অনেকের সহযোগিতায় কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন। সেদিন সাজেদা চৌধুরীর সাহসিকতার কারণে মিজানুর রহমান সফল হতে পারেননি। তা না হলে আওয়ামী লীগের গতিধারা হয়ত অন্যদিকে প্রবাহিত হতো। জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১২ বছরে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে রোল মডেল হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশ এগোচ্ছে দুর্বার গতিতে। তবে দলের বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতা অর্থ ও বাহুবল সম্প্রসারণে মত্ত। আদর্শের কোন বালাই নেই। এখন প্রয়োজন এদের চিহ্নিত করে দলের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ঐ সকল আদর্শহীন নেতাকে দল থেকে বের করে দলকে শক্তিশালী করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশে নতুন প্রজন্মকে আগামী দিনের হাল ধরার জন্য প্রস্তুত করা। তবেই বর্তমান উন্নয়নের ধারা টেকসই ও আরও গতিশীলতা পাবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হবে। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×